দুঃখের নাম ভবদহ

যত দূর চোখ যায় শুধু পানি আর পানি। খেতের ফসল, ঘেরের মাছ—সবই কেড়ে নিয়েছে এই পানি। কেড়ে নিয়েছে থাকার জায়গাটুকুও। যে পানির অপর নাম জীবন, সেই পানিই এখন জীবন কেড়ে নিচ্ছে। পানির কাছে হেরে যাচ্ছে যশোরের ভবদহ অঞ্চলের তিন লাখ মানুষ।

সাজানো–গোছানো ঘর-গেরস্থালি ছিল কনিকা বৈরাগীর। সব এখন পানির নিচে। পরিবারের সদস্য ও গরু-বাছুর নিয়ে তিনি উঠেছেন সড়কে। এগুলোর সঙ্গে ভাগাভাগি করে নিয়েছেন শোবার জায়গা। মনিরামপুর উপজেলার হাটগাছা গ্রামের এই গৃহবধূ বলেন, ‘ঘর জলের তলে। পেটে খিদে। লজ্জায় কারও কাছে হাতও পাততে পারছি না।’

যশোরের অভয়নগর, মনিরামপুর ও কেশবপুর উপজেলা এবং খুলনার ডুমুরিয়া ও ফুলতলা উপজেলার অংশবিশেষ নিয়ে ভবদহ অঞ্চল। পলি পড়ে এই অঞ্চলের পানিনিষ্কাশনের একমাত্র মাধ্যম মুক্তেশ্বরী, টেকা, শ্রী ও হরি নদী নাব্যতা হারিয়েছে। ফলে নদী দিয়ে পানি নামছে না। বৃষ্টি হলেই এলাকার বিলগুলো উপচে ভবদহ অঞ্চলের বেশির ভাগ অংশ তলিয়ে যায়। সৃষ্টি হয় স্থায়ী জলাবদ্ধতার।

সম্প্রতি এলাকার অন্তত ১০টি গ্রাম ঘুরেছেন এ প্রতিনিধি। বাসিন্দারা বলেন, গ্রামগুলোর হাজার হাজার বাড়ি পানিমগ্ন হয়ে আছে। অনেক শিক্ষা ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানও পানিতে ডুবে গেছে। রাস্তা তলিয়ে যাওয়ায় অনেক জায়গা যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে আছে। পানীয় জলের সংকট প্রকট। পয়োনিষ্কাশনব্যবস্থা বলে কিছু নেই। কয়েক হাজার মাছের ঘের ও ফসলের খেত পানিতে তলিয়ে গেছে। ঘরের মধ্যে মাচা করে থাকছে লোকজন। শত শত পরিবার উঁচু সড়কে আশ্রয় নিয়েছে। সাপের কামড়ে এবং পানিতে ডুবে এক মাসে অভয়নগর ও মনিরামপুর উপজেলায় ১২ জনের মৃত্যু হয়েছে।

সড়কের ওপর বাঁশ ও টিন দিয়ে ঘর তৈরি করছিলেন সুজাতপুর গ্রামের গৃহবধূ পুষ্পলতা বৈরাগী। তিনি বলেন, ‘আমরা পাঁচজন লোক। দুটো গরু আর দুটো মুরগি নিয়ে রাস্তার ওপর “আশ্রয়কেন্দ্রে” উঠেছি।’

পুষ্পলতার ‘আশ্রয়কেন্দ্রের’ নাম নওয়াপাড়া-কালীবাড়ি সড়ক। সড়কটির অনেকাংশে পানি উঠে গেছে। যেখানে একটু উঁচু আছে,
সেখানেই উঠেছে কোনো না কোনো পরিবার। অভয়নগরের ডুমুরতলা থেকে মনিরামপুরের লখাইডাঙ্গা পর্যন্ত প্রায় ছয় কিলোমিটার সড়কে পাঁচ শতাধিক পরিবার আশ্রয় নিয়েছে। গরু-ছাগল ও হাঁস-মুরগির সঙ্গে পাশাপাশি থাকছে মানুষ।

লখাইডাঙ্গা গ্রামের সুনীল মল্লিক বলেন, গ্রামে ৬০০ ঘরে লোক বাস করে। এর মধ্যে ২০০ ঘর রাস্তায় আশ্রয় নিয়েছে। বাকিরাও আসতে শুরু করেছে। মনিরামপুর-কুলটিয়া সড়কেও আশ্রয় নিয়েছে দুই শতাধিক পরিবার। সড়কের ডাঙ্গা মহিষদিয়া অংশে বাঁশের খুঁটি পুঁতে তার ওপর পলিথিনের ছাউনি দিয়ে ঘর তৈরি করেছেন রোকেয়া বেগম। বললেন, ‘জীবনে এত পানি দেখিনি। দু-তিন দিন পরপর রান্না করছি। কেউ খোঁজ নেয় না।’

ডহর মশিয়াহাটী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক অরুণ কুমার মণ্ডল বলেন, ‘বিদ্যালয়ের মধ্যে উঁচু বেঞ্চ পর্যন্ত জল উঠে গেছে। বিদ্যালয়ের চারদিকে কোমর পানি। ছাত্রছাত্রীরা আসতে পারছে না। তারপরও বিদ্যালয় খোলা রাখতে হয়েছে।’ মশিয়াহাটী গ্রামের গৃহবধূ কমলা রায় পরিবারের পাঁচজন সদস্যকে নিয়ে উঠেছেন মশিয়াহাটী বহুমুখী উচ্চবিদ্যালয় ভবনের দোতলায়। তিনি বলেন, ‘স্কুলের নিচতলায় জলে ভরা। আরও ১০টি পরিবারের সাথে দোতলার থাকছি।’

মুক্তেশ্বরী ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষ প্রবীর কুমার মল্লিক বলেন, ‘শ্রেণিকক্ষে হাঁটুজল। গত ১৭ আগস্ট থেকে কলেজ বন্ধ রাখা হয়েছে।’

মনিরামপুর উপজেলার কুলটিয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান শেখর চন্দ্র রায় বলেন, ‘আমার ইউনিয়নের ১৭টি গ্রামের ৯৫ শতাংশ বাড়িঘর জলের তলে। নওয়াপাড়া-কালীবাড়ি, মনিরামপুর-কুলটিয়া সড়কসহ কয়েকটি উঁচু সড়কে এ পর্যন্ত এক হাজারেরও বেশি পরিবার আশ্রয় নিয়েছে। এলাকার উঁচু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে শতাধিক পরিবার আশ্রয় নিয়েছে। দুর্গত মানুষের জন্য পাঁচ টন চাল বরাদ্দ পেয়েছি।’

অভয়নগর উপজেলার চলিশিয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান নাদির মোল্যা বলেন, ‘ইউনিয়নের বেদভিটা, বলারাবাদ, ডুমুরতলা ও আন্ধা গ্রাম একেবারেই বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। গ্রামের মানুষ উঁচু রাস্তা ও কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আশ্রয় নিয়েছে। সরকারিভাবে সাড়ে পাঁচ টন চাল বরাদ্দ পেয়েছি। কিন্তু দুর্গত লোকজন চাল নিতে চাচ্ছে না। তাঁদের দাবি, ‘‘পানি সরায়ে দাও”।’

যশোর পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী প্রবীর কুমার গোস্বামী প্রথম আলোকে বললেন, ‘ভবদহ স্লুইসগেট থেকে শ্রী ও হরি নদীর মধ্যে ১০ ফুট চওড়া এবংপাঁচ ফুট গভীর একটি পাইলট চ্যানেল খননের কাজ শুরু হয়েছে। এভাবে শ্রী নদীর দুই কিলোমিটার এবং হরি নদীর তিন কিলোমিটার খনন করা হবে। আশা করছি, এতে পানি নেমে যাবে।’

ভবদহে শ্রী ও হরি নদীতে স্কেভেটর (মাটি কাটার যন্ত্র) দিয়ে পাইলট চ্যানেল করা কাজ শুরু হয়েছে গত সোমবার দুপুরে। স্কেভেটরের চালক মোশাররফ হোসেন গত রাতে মুঠোফোনে বলেন, ‘এই পর্যন্ত শ্রী নদীর মধ্যে এক হাজার ফুট এবং হরি নদীর মধ্যে এক হাজার ফুট চ্যানেল কাটা হয়েছে। এর আগে স্লুইসগেটের সামনে প্রায় ১৫ ফুট গভীর করে পলি অপসারণ করা হয়েছে। এতে করে স্রোতের গতি অনেক বেড়েছে।’ কালিশাকুরল গ্রামের অজয় রায় বলেন,‘চ্যানেল কাটার ফলে এই কয়দিনে প্রায় এক ইঞ্চি পানি কমেছে।’

তবে ভবদহ পানিনিষ্কাশন সংগ্রাম কমিটির আহ্বায়ক রণজিৎ কুমার বাওয়ালীসহ নেতারা মনে করেন, জলাধার প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে জলাবদ্ধতার স্থায়ী সমাধান হতে পারে। রণজিৎ কুমার বাওয়ালী বলেন, ‘আমাদের দাবি, ভবদহ স্লুইসগেট থেকে শোলগাতী পর্যন্ত নদীতে একটা চ্যানেল করে জরুরি ভিত্তিতে পানি সরানো, আমডাঙ্গা খাল সোজাসুজি খনন করে রাজাপুর খালের সাথে সংযোগ দিতে হবে এবং অবিলম্বে বিল কপালিয়ার জোয়ারাধার বাস্তবায়ন করতে হবে।’