জাতীয় পার্টি নিয়ে 'তামাশা' শেষ হয়নি

দশম সংসদ নির্বাচনে জাতীয় পার্টির (জাপা) থাকা না-থাকা নিয়ে ‘তামাশা’ এখনো শেষ হয়নি। এর আগে নির্বাচনকালীন সরকার থেকে জাপার মন্ত্রী-উপদেষ্টাদের পদত্যাগ করা নিয়ে যে নাটকীয় পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল, এখন দলটির নির্বাচন বর্জন এবং প্রার্থীদের মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করা না-করা নিয়েও একই রকম অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।
এরশাদসহ দলের অনেকের মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের আবেদন শেষ পর্যন্ত গৃহীত হয়নি। আবার রওশন এরশাদের নেতৃত্বে দলের একাংশ নির্বাচনে থেকে গেছে। তাঁদের আসনের আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করেছেন। এর মধ্যে জাপার অন্তত পাঁচজন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হতে যাচ্ছেন।
এদিকে জাপার চেয়ারম্যান এইচ এম এরশাদ ‘আটক’, ‘চিকিৎসাধীন’ নাকি সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) ‘অন্তরীণ’ আছেন, তা গতকাল পর্যন্ত তাঁর দলের কেউ স্পষ্ট করেননি। তবে এরশাদ তাঁর বিশেষ উপদেষ্টা ববি হাজ্জাজের মাধ্যমে বলেছেন, তিনি অসুস্থ নন, তাঁকে গ্রেপ্তারের জন্য সিএমএইচে আটকে রাখা হয়েছে। গতকাল শুক্রবার সন্ধ্যায় জাপার গবেষণা ও কৌশল বিভাগের (জেপিআরএসডব্লিউ) প্যাডে গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিজ্ঞপ্তিতে এ কথা জানান ববি হাজ্জাজ।
এর আগে গতকাল দুপুরে এরশাদের ভাই ও জাপার সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য জি এম কাদের সাংবাদিকদের বলেন, ‘কাল রাতে যেভাবে যে প্রক্রিয়ায় ওনাকে (এরশাদ) সিএমএইচে নেওয়া হয়েছে, সেটা আপনারা অবলোকন করেছেন। আমি যদি বলি, তিনি স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় গেছেন, তাহলে আপনারা হয়তো আমার কথা বিশ্বাস করবেন না।’ তিনি আরও বলেন, এরশাদ সুস্থ ও ভালো আছেন। তবে তাঁকে আরও দু-এক দিন হাসপাতালে রাখা হবে। সিএমএইচ কর্তৃপক্ষ আশ্বস্ত করেছে যে এরশাদকে ‘আটক’ করা হয়নি। তিনি যখন ইচ্ছা ফিরে আসতে পারবেন।
বিএনপির উদ্বেগ: বৃহস্পতিবার মধ্যরাতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা এরশাদকে তাঁর বাসা থেকে একরকম জবরদস্তি করে তুলে নিয়ে সিএমএইচে ভর্তি করান। এ ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করে গতকাল বিবৃতি দিয়েছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তিনি বলেন, শুধু একটি পাতানো ও নীলনকশার নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার কারণে এরশাদকে আটক করা হয়েছে। তিনি অবিলম্বে এরশাদের মুক্তি দাবি করেন।
পৃথক বিবৃতিতে নতুন জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান কাজী জাফর আহমদও এরশাদকে ‘গ্রেপ্তারের’ নিন্দা জানিয়ে নিঃশর্ত মুক্তি দাবি করেন।
অনড় এরশাদ: গতকাল সকালে জি এম কাদের ও জাপার মহাসচিব রুহুল আমিন হাওলাদার সিএমএইচে এরশাদের সঙ্গে দেখা করেন। সেখান থেকে ফিরে দুপুর সোয়া ১২টায় জি এম কাদের এক সংবাদ ব্রিফিংয়ে বলেন, আসন্ন নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করার বিষয়ে এরশাদ তাঁর সিদ্ধান্তে এখনো অটল। দলের প্রার্থীদের মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের যে নির্দেশ দিয়েছেন, তা-ও বহাল আছে। গুলশানে রুহুল আমিন হাওলাদারের ব্যবসায়িক কার্যালয়ে এ ব্রিফিংয়ে রুহুল আমিন ও এরশাদের মুখপাত্র কাজী ফিরোজ রশীদ উপস্থিত ছিলেন।
রওশনসহ পাঁচ মন্ত্রী-উপদেষ্টা নির্বাচনে: দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ২৪৮ আসনে জাপার প্রার্থীরা মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছিলেন। এরপর ৩ ডিসেম্বর এরশাদ আকস্মিক নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা এবং পরদিন দলের প্রার্থীদের মনোনয়নপত্র তুলে নিতে নির্দেশ দেন। কিন্তু তাঁর স্ত্রী রওশন এরশাদসহ সরকারে থাকা জাপার পাঁচজন মন্ত্রী-উপদেষ্টা গতকাল শেষ দিনেও মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করেননি। এর মধ্য দিয়ে রওশন এরশাদের নেতৃত্বে জাপার একটি অংশের নির্বাচনে থেকে যাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত হয়ে উঠেছে। বেশ কিছু আসনে গতকাল শেষ দিনে আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করে জাপাকে আসন ছেড়ে দিয়েছেন। এর মধ্যে দলের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য রওশন এরশাদ (ময়মনসিংহ-৪), আনিসুল ইসলাম মাহমুদ (চট্টগ্রাম-৫ আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায়), জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলু (চট্টগ্রাম-৯), মজিবুল হক চুন্নু (কিশোরগঞ্জ-৩), সালমা ইসলাম (ঢাকা-১) অন্যতম।
তবে জাপার মহাসচিব রুহুল আমিন হাওলাদার ও তাঁর স্ত্রী রত্না আমিন হাওলাদার গতকাল মনোনয়ন প্রত্যাহার করে নিয়েছেন। আর এরশাদ, জি এম কাদের মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের আবেদন করলেও তা গৃহীত হয়নি। আর জাপার সভাপতিমণ্ডলীর আরেক সদস্য কাজী ফিরোজ রশীদ প্রথম আলোকে বলেছেন, তিনি মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করেছেন। কিন্তু রিটার্নিং কর্মকর্তার কার্যালয় বলছে, তাঁর মনোনয়ন বহাল আছে।
এরশাদকে নির্বাচনে ধরে রাখতে ব্যর্থ হয়ে সরকার বিকল্প হিসেবে রওশন-আনিস-বাবলুর নেতৃত্বে জাপার একটি অংশকে নির্বাচনে রাখার কৌশল নেয়। এঁদের সঙ্গে সরকার ১০ দিন ধরে নানা দেনদরবার ও গোপন সমঝোতা করে বলে দলীয় সূত্রগুলো জানায়।
এরপর গত বৃহস্পতিবার এরশাদ নির্বাচন কমিশনে চিঠি দিয়ে দলীয় প্রতীক লাঙ্গল কাউকে বরাদ্দ না দিতে অনুরোধ জানান। এর ১২ ঘণ্টার মধ্যে বৃহস্পতিবার রাত ১১টা ৪০ মিনিটে এরশাদকে তাঁর বাসা থেকে আটক করে সিএমএইচে নেওয়া হয়।
রওশনের বাসায় দিনভর তৎপরতা: এদিকে গতকাল দিনভর রওশন এরশাদের গুলশানের বাসায় আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, জিয়াউদ্দিন বাবলুসহ দলের একাংশ দফায় দফায় বৈঠক করে। সন্ধ্যা সোয়া সাতটায় তাঁর বাসায় যান আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ নেতা তোফায়েল আহমেদ ও প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা গওহর রিজভী। তাঁরা প্রায় ৪০ মিনিট সেখানে ছিলেন। এ সময় হঠাৎ রওশনের বাসার সামনে র্যাব ও পুলিশের উপস্থিতি বেড়ে যায়। কিছুক্ষণ পর আবার চলে যায়। তোফায়েল আহমেদ ওই বাসা থেকে বেরিয়ে সিএমএইচে গিয়ে এরশাদের সঙ্গে দেখা করেন বলেও রাতে খবর বের হয়।
যেভাবে এরশাদকে নেওয়া হলো: প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, বৃহস্পতিবার রাত পৌনে ১১টার দিকে পুলিশের একটি গাড়ি আসে এরশাদের বারিধারার বাসার সামনে। এর কিছুক্ষণ পর গুলশান থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা রফিকুল ইসলাম আসেন। এর পরই একদল দাঙ্গা পুলিশ এসে এরশাদের বাড়ির চারদিক ঘেরাও করে ফেলে। এ সময় এরশাদের বাড়ির সামনের রাস্তায় যানবাহন চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়। কিছুক্ষণ পর র্যাব-১-এর দুটি গাড়ি আসে। গাড়ি দুটি এসে বাড়ির সামনের অংশে চক্কর দিয়ে চলে যায় পেছনের ফটকে। র্যাবের আট-নয়জন সদস্য নেমে সোজা ওপরে উঠে যান।
এ সময় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অপেক্ষমাণ সাংবাদিক ও জাপার উপস্থিত নেতা-কর্মীদের সরিয়ে দেয়। নিভিয়ে দেওয়া হয় বাসার নিচতলার বাতি।
প্রত্যক্ষদর্শী একজন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, র্যাব কর্মকর্তাদের কয়েকজন ছিলেন সাদা পোশাকে। তাঁরা ভেতরে ঢুকে এরশাদকে তাঁদের সঙ্গে আসতে বলেন। এরশাদ তখন জানতে চান, তাঁর বিরুদ্ধে কোনো পরোয়ানা আছে কি না। জবাবে কর্মকর্তারা কিছু না বলে তাঁকে উঠে আসতে অনুরোধ করেন। এই পর্যায়ে এরশাদ উচ্চ স্বরে বারবার জানতে চান, তাঁকে কেন গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। র্যাবের কর্মকর্তারা কোনো কথা না বলে তাঁকে নিয়ে যাওয়ার জন্য পীড়াপীড়ি করেন। একপর্যায়ে এরশাদ কেঁদে ফেলেন বলেও একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন।
এরশাদকে নিয়ে যাওয়ার সময় নিচে দাঁড়ানো তাঁর ব্যক্তিগত কর্মীরা কান্নাকাটি করেন। কেউ কেউ গাড়ির সামনে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু পুলিশের প্রতিরোধের মুখে তাঁরা এগোতে পারেননি। রাত ১১টা ৪০ মিনিটে এরশাদকে নিয়ে র্যাব সিএমএইচের দিকে রওনা হয়।
অবশ্য ওই রাতে র্যাব-১-এর পরিচালক লে. কর্নেল কিসমত হায়াত বলেন, এরশাদের শরীর খারাপ, সে কারণে তাঁর ইচ্ছায় সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য নেওয়া হচ্ছে।