রাজধানীতে ২০ মিনিটের তাণ্ডব, ধ্বংসযজ্ঞ

জুমার নামাজের পর রাজধানীর কমলাপুর এলাকায় গতকাল জামায়াত-শিবিরের কর্মীদের ঝটিকা মিছিল থেকে নির্বিচারে গাড়ি ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়। এ সময় পথচারী ও আশপাশের বাসিন্দাদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে | ছবি: হাসান রাজা
জুমার নামাজের পর রাজধানীর কমলাপুর এলাকায় গতকাল জামায়াত-শিবিরের কর্মীদের ঝটিকা মিছিল থেকে নির্বিচারে গাড়ি ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়। এ সময় পথচারী ও আশপাশের বাসিন্দাদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে | ছবি: হাসান রাজা

বেলা পৌনে দুইটায় শুরু, চলে ২০ মিনিট। এ সময়েই রাজধানীর মতিঝিলে আইডিয়াল স্কুলের সামনে ও আশপাশে ব্যাপক তাণ্ডব ও ধ্বংসলীলা চালিয়েছে জামায়াত-শিবির। মুহুর্মুহু ককটেল বিস্ফোরণ ঘটিয়ে তারা পুড়িয়ে দিয়েছে ব্যক্তিগত গাড়িসহ ১৭টি যানবাহন, রিকশা, রিকশাভ্যান, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের পসরা, সিটি করপোরেশনের একটি আঞ্চলিক কার্যালয়।
গতকাল শুক্রবার নির্বিচারে ভাঙচুর-অগ্নিসংযোগ, ককটেলের বিকট শব্দ, আতঙ্কিত মানুষের দিগিবদিক ছোটাছুটিতে সেখানে ওই সময় সৃষ্টি হয় নারকীয় পরিবেশ। পুলিশ-র্যাবকে লক্ষ্য করেও ককটেল ছোড়েন জামায়াত-শিবিরের কর্মীরা। এ সময় গুলিবিদ্ধ হয় ১১ বছরের শিশু শান্ত ইসলামসহ অন্তত ১২ জন। সেখান থেকে আটক করা হয় ১৪ জনকে। প্রায় একই সময়ে কমলাপুরে কয়েকটি যান ভাঙচুর ও একটি কাভার্ড ভ্যানে অগ্নিসংযোগ এবং মালিবাগ চৌধুরীপাড়ায় একটি পিকআপ ও একটি বাসে অগ্নিসংযোগ করেন তাঁরা।
মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে জামায়াতের নেতা আবদুল কাদের মোল্লার ফাঁসির রায় কার্যকরের প্রতিবাদে এমন তাণ্ডব চালায় জামায়াত-শিবির।
পুলিশ জানিয়েছে, কাদের মোল্লার ফাঁসিকে কেন্দ্র করে নাশকতার আশঙ্কায় জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমকে ঘিরে পুলিশের সবচেয়ে বেশি প্রস্তুতি ছিল। এজিবি কলোনি এলাকায় পুলিশ মোতায়েন থাকলেও সংখ্যায় ছিল তুলনামূলক কম।
বেলা পৌনে তিনটায় এজিবি কলোনি ও আইডিয়াল স্কুলের সামনে গিয়ে দেখা যায় আরামবাগ থেকে মাজার রোডের মোড় পর্যন্ত সড়কজুড়ে ধ্বংসযজ্ঞের চিহ্ন। বাতাসে পোড়া গন্ধ। এজিবি কলোনিসংলগ্ন সড়কে হলিডে মার্কেটের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের ভ্যানে আনা শীতের পোশাক পুড়ে ধোঁয়া বের হচ্ছে। পুড়ে যাওয়া গাড়ি ও মোটরসাইকেলগুলো পড়ে আছে। সড়কে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে ডাব, ডাবের খোসা, প্লাস্টিকের অস্থায়ী সড়ক বিভাজক এবং প্রচুর ইটপাটকেল। ক্ষতিগ্রস্ত লোকজন কান্নাকাটি, আহাজারি করছেন।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, বেলা পৌনে দুইটার দিকে জামায়াত-শিবিরের অন্তত ৩০০ নেতা-কর্মী এজিবি কলোনির সামনে থেকে লাঠিসোঁটা হাতে মিছিল শুরু করেন। তাঁরা একের পর এক ককটেলের বিস্ফোরণ ঘটাতে থাকেন। একপর্যায়ে তাঁরা কয়েক ভাগে বিভক্ত হয়ে তাণ্ডব শুরু করেন। একটি অংশ এজিবি কলোনির কাঁচাবাজারসংলগ্ন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ১৪ নম্বর ওয়ার্ডের অঞ্চল-২ কার্যালয়ের তালা ভেঙে ভেতরে ভাঙচুর চালায়। পরে তারা পেট্রল ঢেলে ওই কার্যালয়ে আগুন ধরিয়ে দেয়। মিছিলকারীদের আরেকটি অংশ আইডিয়াল স্কুলের কাছে কয়েকটি ককটেলের বিস্ফোরণ ঘটায়। এ সময় ওই স্কুলে বার্ষিক পরীক্ষায় অংশ নিতে আসা শিক্ষার্থী-অভিভাবকেরা আতঙ্কিত হয়ে ছোটাছুটি শুরু করেন। স্কুলের ফটক দিয়ে দ্রুত ঢুকতে গিয়ে পড়ে গিয়ে কয়েকজন আহত হন। মিছিলকারীরা পাশে থেমে থাকা দুটি গাড়িতে এবং সিটি করপোরেশনের অঞ্চল-২ কার্যালয়ের পাশে আরও দুটি গাড়িতে পেট্রল ঢেলে অগ্নিসংযোগ করেন। সড়কের উল্টো পাশে থাকা একটি মোটরসাইকেল জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। হলিডে মার্কেটে ভ্যানে থাকা কাপড়চোপড়ে অগ্নিসংযোগ করা হয়। পুরে এলাকা ধোঁয়াচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। ২০-২৫ গজ দূরে থাকা অল্প কয়েকজন পুলিশ সদস্য এগোনোর চেষ্টা করলে জামায়াত-শিবির কর্মীরা কয়েকটি ককটেল ছুড়ে তাঁদের পিছু হটিয়ে দেন। এরপর তাণ্ডবকারীরা আরামবাগ মোড়ের দিকে চলে আসেন। পরে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা ঘটনাস্থলে গিয়ে আগুন নেভান।
পরে পুলিশ আরামবাগের পাশের গলিতে ঢুকে জামায়াত-শিবির কর্মীদের ছত্রভঙ্গ করতে শটগানের গুলি ছোড়ে। এ সময় শিশু শান্তসহ অন্তত ১২ জন আহত হন। তাঁদের ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
প্রত্যক্ষদর্শী মিজানুর রহমান জানান, ভাগনেকে আইডিয়াল স্কুলে ঢুকিয়ে দিয়ে ফুটপাতের একটি দোকানে চা পান করছিলেন তিনি। এ সময় জামায়াত-শিবিরের কর্মীরা ব্যাগ থেকে ককটেল বের করে বিস্ফোরণ ঘটাতে থাকেন। তাঁরা পুলিশ লক্ষ্য করে ইটপাটকেল ও ককটেল ছুড়লে পুলিশ পিছু হটে। রাজারবাগের দিক থেকে আসা র্যাবের একটি গাড়ি থেকে দুটি গুলি ছোড়া হলেও সেটিও পিছু হটে। এ সুযোগে ধ্বংসযজ্ঞ চালানো হয়। নাশকতাকারীরা চলে যাওয়ার পর পুলিশ আসে।
পুড়ে যাওয়া একটি গাড়ির মালিক মিলি চৌধুরী হলি ফ্যামিলি রেড ক্রিসেন্ট হাসপাতালের চিকিৎসক। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর ছেলে আইডিয়াল স্কুলে নবম শ্রেণীতে পড়ে। হরতাল-অবরোধের কারণে বার্ষিক পরীক্ষা শেষ হয়নি। গতকাল দুই বেলায় দুটি পরীক্ষা ছিল। বিরতির পর ছেলে দ্বিতীয় পরীক্ষার জন্য স্কুলে ঢুকলে তিনি ফটকের বাইরে ছিলেন। এ সময় মুহুর্মুহু ককটেলের বিস্ফোরণ ঘটে। সিটি করপোরেশনের অঞ্চল-২ কার্যালয়ের কাছে থাকা তাঁর গাড়িটি পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, ‘ওই সময় আমি গাড়িতে থাকলে পুড়ে যেতাম।’

ছুটির দিন হলেও গতকাল রাজধানীর অনেক স্কুল খোলা ছিল। মেয়েকে নিয়ে স্কুল থেকে ফেরার পথে দুপুরে সংঘর্ষের মধ্যে পড়েন এই অভিভাবক। আতঙ্কে তিনি দিগ্বিদিক ছুটতে থাকেন। আরামবাগ এলাকা থেকে ছবিটি তোলা |  প্রথম আলো
ছুটির দিন হলেও গতকাল রাজধানীর অনেক স্কুল খোলা ছিল। মেয়েকে নিয়ে স্কুল থেকে ফেরার পথে দুপুরে সংঘর্ষের মধ্যে পড়েন এই অভিভাবক। আতঙ্কে তিনি দিগ্বিদিক ছুটতে থাকেন। আরামবাগ এলাকা থেকে ছবিটি তোলা | প্রথম আলো

মিলি চৌধুরীর গাড়ির চালক মোস্তাফিজুর রহমান ধরা গলায় বলেন, তিনি চালকের আসনে বসেছিলেন। হঠাৎ ২৫-৩০ জন যুবক লাঠি দিয়ে গাড়ির কাচ ভেঙে তাঁকে টেনে বাইরে বের করে পেটান। এরপর গাড়িতে পেট্রল ঢেলে আগুন দেন।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, মিছিলকারীদের আরেকটি অংশ আরামবাগ মোড়ের কাছে ইট ও ককটেল নিক্ষেপ করে পুলিশকে হটিয়ে দেয়। পরে তারা অন্তত ১০টি মোটরসাইকেল ভাঙচুর করে। এর মধ্যে পাঁচটি মোটরসাইকেল পেট্রল ঢেলে জ্বালিয়ে দেয়।
একই সময়ে কমলাপুরে বীরশ্রেষ্ঠ মোস্তফা কামাল স্টেডিয়ামসংলগ্ন এলাকায় জামায়াত-শিবিরের কর্মীরা কয়েকটি ককটেলের বিস্ফোরণ ঘটান। তাঁরা কয়েকটি যানবাহন ভাঙচুর করেন এবং একটি কাভার্ড ভ্যানে অগ্নিসংযোগ করেন।
পুলিশের মতিঝিল বিভাগের উপকমিশনার মহাম্মদ আশরাফ-উজ-জামান বলেন, শিবিরের কর্মীরা তিন দিক থেকে আক্রমণ করলে পুলিশ এক দিকে আটকে যায়। তাঁরা এ সুযোগটাই কাজে লাগিয়েছেন। সাধারণ মানুষ আহত হওয়ার আশঙ্কা থাকায় পুলিশ গুলি চালায়নি। পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে ১৪ জনকে আটক করে।
প্রায় একই সময়ে রামপুরা থেকে জামায়াত-শিবির মিছিল নিয়ে মালিবাগ চৌধুরীপাড়ায় আসে। তারা আবুল হোটেলের উল্টো দিকে উপর্যুপরি ককটেল ফাটায় ও রাস্তায় পেট্রল ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয়। উত্তরা ব্যাংক মালিবাগ চৌধুরীপাড়া শাখার কাচও ভাঙচুর করে। রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা একটি ওষুধ কোম্পানির পিকআপ ভ্যানে আগুন দেয় তারা। এ অবস্থা দেখে যাত্রীভর্তি অনাবিল পরিবহনের একটি বাস ঘুরিয়ে এলাকা ত্যাগের চেষ্টা করে। ওই বাসে ভাঙচুর চালিয়ে আগুন ধরিয়ে দেন জামায়াত-শিবিরের কর্মীরা। এই দুটি যানের আগুন পরে নিভিয়ে ফেলা হয়।
এ ছাড়া সকালে খিলগাঁও, পল্টন, সোবহানবাগ ও তেজগাঁওয়ের নাবিস্কো মোড়ে জামায়াত-শিবিরের কর্মীরা মিছিল বের করলে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ হয়। পুলিশ শটগানের গুলি ছুড়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে।