সার্কের ভবিষ্যৎ গভীর সংকটে

সার্ক
সার্ক
মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার নিয়ে পাকিস্তান নাক গলানোয় সার্কে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের। একই দিনে চার দেশের বর্জন এবারই প্রথম

তিন দশকের ইতিহাসে সার্ক শীর্ষ সম্মেলন স্থগিত হওয়া কিংবা পিছিয়ে যাওয়াটা নতুন নয়। তবে একই দিনে চারটি দেশের সার্ক শীর্ষ সম্মেলনে না যাওয়ার সিদ্ধান্তটা এবারই প্রথম। তা ছাড়া সাম্প্রতিক সময়ে সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ নিয়ে পাকিস্তানের সঙ্গে ভারত ও আফগানিস্তানের চরম উত্তেজনা আর বাংলাদেশে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার নিয়ে পাকিস্তানের অযাচিত হস্তক্ষেপ আঞ্চলিক সহযোগিতায় বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই দ্বিপক্ষীয় টানাপোড়েনের জের ধরে ইসলামাবাদে সার্ক শীর্ষ সম্মেলন স্থগিত হয়ে যাওয়া দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক সহযোগিতার ক্ষেত্রে বড় ধরনের আঘাত।

অভিন্ন দক্ষিণ এশিয়ার পরিচয় তুলে ধরতে বাংলাদেশের উদ্যোগে ১৯৮৫ সালে যাত্রা শুরু করেছিল সার্ক। যে আকাঙ্ক্ষা নিয়ে দক্ষিণ এশিয়া আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থার (সার্ক) শুরু, দীর্ঘ ৩১ বছর পরও সেটি মোটামুটি প্রতীকী সংগঠনই থেকে গেছে। অতীতের বিভিন্ন পর্যায়ে আট জাতির এই জোট বড় দুই দেশ ভারত ও পাকিস্তানের বৈরিতায় বারবার হোঁচট খেয়েছিল। এই প্রথমবার দেখা গেল, শুধু দুই দেশই নয়, বাংলাদেশসহ আরও তিন দেশ একসঙ্গে তাদের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের টানাপোড়েনকে আঞ্চলিক সহযোগিতার পথে প্রতিবন্ধকতা হিসেবে বলছে। সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহে দীর্ঘদিন খুঁড়িয়ে চলা সার্কের ভবিষ্যৎ এখন গভীর সংকটের মুখে পড়ল।

একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের মতো অভ্যন্তরীণ বিষয়ে অব্যাহতভাবে নাক গলানোয় ইসলামাবাদে সার্ক শীর্ষ সম্মেলনে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশের এ সিদ্ধান্ত একান্তই নিজস্ব, অন্য কোনো দেশের সঙ্গে এর সম্পর্ক নেই। ইসলামাবাদে প্রস্তাবিত ১৯তম সার্ক শীর্ষ সম্মেলনে না যাওয়ার কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলম গতকাল বুধবার তাঁর দপ্তরে সাংবাদিকদের এসব কথা বলেন।

কাঠমান্ডুতে সার্ক সচিবালয়ে কাজ করেছেন বাংলাদেশের এমন চার কূটনীতিকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, অতীতে বিভিন্ন সময় কোনো সদস্যদেশের কারণে সার্ক শীর্ষ সম্মেলন স্থগিত হয়েছে, পিছিয়েছে। কিন্তু একসঙ্গে চার দেশের সরে দাঁড়ানোর নজির নেই। তা ছাড়া নাম উল্লেখ না করে স্বাগতিক দেশের ভূমিকা নিয়ে অন্য দেশের প্রশ্ন তোলার বিষয়টিও তেমন একটা ঘটেনি। ফলে সব মিলিয়ে আঞ্চলিক সহযোগিতার ভবিষ্যৎ সংকটে পড়ে গেল।

জানতে চাইলে সার্ক সচিবালয়ের সাবেক মহাসচিব ও বাংলাদেশের কূটনীতিক কিউ এ এম এ রহিম গতকাল রাতে প্রথম আলোকে বলেন,প্রতিষ্ঠার পর থেকেই জোটের বড় দুই সদস্যের বৈরী সম্পর্কের কাছে জিম্মি হয়ে থেকেছে সার্ক। আঞ্চলিক সহযোগিতার যে আশা নিয়ে সার্কের যাত্রা হয়েছিল, তা পূরণ হয়নি। শীর্ষ সম্মেলন না হলে বিভিন্ন স্তরের বৈঠক করে সার্ককে এগিয়ে নেওয়ার সুযোগও কমে আসছে।

বাংলাদেশ, ভারত, আফগানিস্তান ও ভুটান একই দিনে সার্ক শীর্ষ সম্মেলনে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত গত মঙ্গলবার জোটের বর্তমান সভাপতি দেশ নেপালকে জানিয়ে দিয়েছে। চার দেশ একই দিনে এমন সিদ্ধান্ত নেওয়ায় সার্কের শীর্ষ নেতাদের সম্মেলনটি স্থগিত হয়ে গেল। এ ছাড়া স্বাগতিক দেশ পাকিস্তান যেভাবে সদস্যদেশগুলোকে শীর্ষ সম্মেলনে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল, সেটিও নজিরবিহীন। সাধারণত স্বাগতিক দেশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী কিংবা সরকারপ্রধানের বিশেষ দূত হিসেবে কাউকে সদস্যদেশগুলোতে পাঠিয়ে শীর্ষ সম্মেলনের আমন্ত্রণ জানিয়ে থাকে। গত মার্চে নেপালের পোখরায় সার্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের বৈঠকে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর পররাষ্ট্রবিষয়ক উপদেষ্টা সারতাজ আজিজ সদস্যদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের হাতে সার্কের আমন্ত্রণপত্র তুলে দেন।

ভারতের ইন্ডিয়া টুডে গতকাল এক খবরে জানিয়েছে, সার্কের বর্তমান সভাপতি দেশ হিসেবে নেপাল শীর্ষ সম্মেলন আয়োজনে ইসলামাবাদের বিকল্প স্থান খুঁজতে শুরু করেছে। গতকাল কাঠমান্ডুতে এক উচ্চপর্যায়ের বৈঠকে নেপালের প্রধানমন্ত্রী পুষ্প কমল দহল প্রচন্ড এ বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেছেন বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।

গতকাল দুপুরে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী তাঁর দপ্তরে সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমরা গতকাল সার্কের সভাপতি দেশ নেপাল ও সার্ক সচিবালয়কে চিঠি দিয়ে জানিয়েছি যে নভেম্বরে অনুষ্ঠেয় ১৯তম সার্ক শীর্ষ সম্মেলনে বাংলাদেশ যোগ দিচ্ছে না। কারণ হিসেবে আমরা বলেছি, বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে একটি রাষ্ট্রের ক্রমাগত হস্তক্ষেপ এমন এক পরিবেশের সৃষ্টি করেছে, যা সফলভাবে সার্ক শীর্ষ সম্মেলন আয়োজনের জন্য সহায়ক নয়। পাশাপাশি আমরা বলেছি, সার্কের প্রতিষ্ঠাতা দেশ হিসেবে বাংলাদেশ আঞ্চলিক সহযোগিতা, কানেকটিভিটি ও সার্বিক সহযোগিতার বিষয়টি বিশ্বাস করে। সময় ও সুযোগ যখন আসবে, বাংলাদেশ তখন সার্ক শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দেবে।’ বাংলাদেশের এই সিদ্ধান্তের সঙ্গে অন্য কোনো রাষ্ট্রের সিদ্ধান্তের কোনো সম্পর্ক নেই বলে মন্তব্য করেন তিনি।

সার্ক শীর্ষ সম্মেলন পাকিস্তানে হচ্ছে বলেই বাংলাদেশ যাচ্ছে না—এমন প্রশ্নের জবাবে শাহরিয়ার আলম বলেন, ‘সার্কে অংশ না নেওয়ার বিষয়ে মতামত ব্যক্ত করাটা নতুন কিছু নয়। পরিবেশ হলে বাংলাদেশ সার্ক শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দেওয়ার বিষয়টি বিবেচনা করবে, স্থান গুরুত্বপূর্ণ নয়। আমরা যেটা বলেছি, বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে অব্যাহতভাবে পাকিস্তান হস্তক্ষেপ করছে।’

ভারতের উরিতে সাম্প্রতিক হামলার ঘটনায় পাকিস্তানকে একঘরে করার যে বিষয়টি আলোচনায় এসেছে, বাংলাদেশের সিদ্ধান্তের সঙ্গে এর কোনো যোগসূত্র আছে কি না, এমন প্রশ্নের উত্তরে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘আমি সেটা বলব না। এটি বাংলাদেশের নিজস্ব একটি সিদ্ধান্ত। আমরা সব সময় বলে আসছি, বাংলাদেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব, বঙ্গবন্ধু, বঙ্গবন্ধু হত্যাকারীদের বিচার ও ফাঁসির রায় কার্যকর, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার—এসব বিষয়ে বাংলাদেশ কখনো কারও সঙ্গে আপস করেনি এবং করবেও না।’

পাকিস্তানের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করা হবে কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘সেটা সময়ই বলে দেবে।’