স্বপ্নপূরণে হার না-মানা কিশোরীরা

স্বপ্নপূরণে হার না-মানা কিশোরীরা। ছবি: মানসুরা হোসাইন
স্বপ্নপূরণে হার না-মানা কিশোরীরা। ছবি: মানসুরা হোসাইন

অতীতটা কেবলই কষ্টের। সে কথা বলতে গেলে চোখ ছলছল করে ওঠে। তাই পিছু ফিরে তাকাতেও চায় না ওরা। কষ্টকে জয় করে এখন কেবলই সামনে চলার সময়। স্বপ্নপূরণের পথে এগিয়ে চলার সময়।
সোনালি সেসব স্বপ্নপূরণের পথে এগিয়ে চলছে কিশোরী সিলভিয়া আহমেদ, রাবেয়া আক্তার, মিলি শরিফ, জোবেদা ও বিবি আয়েশারা। রাজধানীর চানখাঁরপুলে বেসরকারি সংগঠন অপরাজেয়-বাংলাদেশের ড্রপ-ইন সেন্টার ও মোহাম্মদপুরে মেয়েদের একটি হোস্টেলে দেখা মেলে ওদের।

সিলভিয়া, রাবেয়া, মিলি ও জোবেদা থাকে ড্রপ ইন সেন্টারে। আর বিবি আয়েশা থাকে মোহাম্মদপুরে।

সিলভিয়া আহমেদ এসএসসি পরীক্ষার্থী। টেলিভিশন চ্যানেল এটিএন বাংলায় শিশু সাংবাদিক হিসেবে কাজ করেছে দুই বছর। জাতিসংঘ শিশু তহবিলের (ইউনিসেফ) সহায়তায় ‘চিলড্রেন টেলিভিশন ফাউন্ডেশন অব বাংলাদেশ’ প্রকল্পের আওতায় এটিএন বাংলায় প্রতি শুক্রবার সন্ধ্যা সাতটার সংবাদে সিলভিয়ার বেশ কয়েকটি প্রতিবেদন প্রচারিত হয়েছে। ক্যামেরা চালানো, সম্পাদনা প্যানেল, স্ক্রিপ্ট লেখা সবই পারে সিলভিয়া। এক মিনিটের ‘নো নেগলেক্ট’ নামে একটি
চলচ্চিত্রও নির্মাণ করেছে সে। তবে এখন ইউনিসেফের প্রকল্পের মেয়াদ শেষ। তাই আপাতত সাংবাদিকতা বন্ধ। তবে সিলভিয়ার ইচ্ছা রেডিওতে কথাবন্ধু বা আরজে হিসেবে কাজ করা।

অপরাজেয় বাংলাদেশের হয়ে সিলভিয়া কয়েক বছর আগে শিশু অধিকার সপ্তাহের একটি অনুষ্ঠানে সরাসরি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে প্রশ্ন করার সুযোগ পেয়েছিল। সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনি, সাংসদ মমতাজসহ অনেকের সঙ্গেই তখন কথা বলার সুযোগ হয়েছে। ২৭ সেপ্টেম্বর তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনুর সঙ্গে একটি অনুষ্ঠানে দেখা হয়। বাংলাদেশ টেলিভিশনে ‘আমাদের কথা’ শীর্ষক অনুষ্ঠানেও অংশ নিয়েছে। অপরাজেয় বাংলাদেশের একটি প্রকল্পে তরুণদের শিক্ষক বা ইয়ুথ এডুকেটর হিসেবে কাজ করছে।

সাংবাদিক হিসেবে সিলভিয়াকে এখন অনেকেই চেনে। তার বয়স যখন দেড় বছর তখন মা মারা যান। সিলভিয়ার ছোট বোনের বয়স তখন মাত্র তিন মাস। বাবা আরেকটি বিয়ে করেন। ওদের ফেলে চলে যান। নানি দুই বোনকে কিছুদিন নিজের কাছে রাখেন। পরে আশ্রয় মেলে ড্রপ-ইন সেন্টারে। সিলভিয়া জানে বাবা তাকে দেখলেও চিনবেন না। মায়ের চেহারাও এখন আর মনে নেই। তবে সব বাধা আর দুঃখকে জয় করে সিলভিয়া এগিয়ে চলেছে। তাই দৃঢ় গলায় জানাল, ‘আগে কখনো কল্পনা করিনি জীবনে এত দূর আসতে পারব। অপরাজেয় বাংলাদেশ সে সাহস জুগিয়েছে। পাশে থেকেছে। এখন বলতে পারি, ভবিষ্যতে আমি কিছু একটা হবই।’

রাবেয়া আক্তার পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ে। মাত্র নয় বছর বয়সে গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করতে গিয়ে নির্যাতনের শিকার হয়। সেই বাড়ি থেকে পালাতে গিয়ে হারিয়ে যায়। মা-বাবা বা পরিবারের কাউকে খুঁজে পায়নি। আশ্রয় মেলে ড্রপ-ইন সেন্টারে। এখন রাবেয়া সকাল আটটা থেকে সাড়ে দশটা পর্যন্ত স্কুলে পড়ে। তারপর পুরান ঢাকার একটি পারলারে কাজ করে। কাজ শেষ হয় রাত সাড়ে নয়টায়। সারা দিন দাঁড়িয়ে কাজ করতে তার ভালো লাগে না। নিজের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে টাকা জমাচ্ছে। ভবিষ্যতে একটি পারলারের মালিক হতে চায় রাবেয়া।

মিলি জানে তার বাবার নামের সঙ্গে শরিফ ছিল। তাই নিজেই স্কুলের খাতায় নাম লিখেছে মিলি শরিফ। বাবা আর মা দুজনই আবার বিয়ে করে তাকে ফেলে চলে গেছেন। বাংলাদেশ টেলিভিশনে ইউনিসেফের প্রকল্পের আওতায় সে-ও শিশু সাংবাদিক হিসেবে কাজ করেছে। ‘ম্যাজিক পেনসিল’ নামে এক মিনিটের একটি চলচ্চিত্র তৈরি করেছে। অষ্টম শ্রেণিতে পড়ার পাশাপা​শি বাংলাদেশ কারিগরি বোর্ডের অধীনে কম্পিউটার শিখছে। ড্রপ-ইন সেন্টারে মিলি ও অন্যরা মিলে নিজেরাই স্যানিটারি ন্যাপকিন বানাচ্ছে। সেন্টারে মেয়েদের ক্রিকেট দলেরও সদস্য মিলি। সাহস নিয়ে অকপটে জানাল সে ভবিষ্যতে দেশের প্রধানমন্ত্রী হতে চায়।

মাত্র সাত বছর বয়সে জোবেদার বাবা মারা যান। মা মিরপুরের একটি মাজারে কাজ করতেন। জোবেদা মাজারে মায়ের সঙ্গেই থাকত। একসময় মা-ও হারিয়ে যান। তারপর জোবেদা আসে ড্রপ-ইন সেন্টারে। এখন সে অষ্টম শ্রেণিতে পড়ছে। দরজির প্রশিক্ষণ নিচ্ছে। বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ দলের সদস্য হিসেবে নাটক, থিয়েটারের মাধ্যমে এলাকায় সচেতনতা তৈরির কাজ করছে জোবেদা। নিজেই একটা দরজির দোকান দেওয়ার স্বপ্ন জোবেদার। এর পাশাপাশি পড়াশোনা শেষ করে ব্যাংকারও হতে চায় সে।

১৭ বছরের বয়সী বিবি আয়েশা নিজের মায়ের সম্পর্কে কিছু জানে না। ঘরে সৎমায়ের অত্যাচারে অতিষ্ঠ ছিল। বাড়ি থেকে বেরিয়ে হারিয়ে যায়। থানার মাধ্যমে অপরাজেয় বাংলাদেশের আশ্রয়ে আসে। এখন নবম শ্রেণিতে বিজ্ঞান বিভাগে পড়ছে। পঞ্চম শ্রেণিতে সমাপনী পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পেয়েছিল। অষ্টম শ্রেণিতে জেএসসি পরীক্ষায় অল্পের জন্য জিপিএ-৫ হাতছাড়া হয়ে যায়। পড়াশোনার পাশাপাশি তরুণদের শিক্ষক বা ইয়ুথ এডুকেটর হিসেবে সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের পড়াশোনা শেখাচ্ছে। শিক্ষক অথবা সমাজকর্মী হতে চায় সে।

মোহাম্মদপুর হোস্টেলের ব্যবস্থাপক মাহফুজা আক্তার এবং চানখাঁরপুলের ড্রপ-ইন সেন্টারের ব্যবস্থাপক রোকসানা বেগম জানান, অবহেলিত, সুবিধাবঞ্চিত এই কিশোরীরা ১৮ বছর বয়স পর্যন্ত সংগঠনের আশ্রয়ে থাকা-খাওয়াসহ সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা পাবে। পড়াশোনা শেষ না হলে তারা আরও কিছুদিন থাকার সুযোগ পাবে। আর যারা কারিগরি প্রশিক্ষণ নেয় তারা বিভিন্ন কাজের সঙ্গে যুক্ত হয়। সেন্টার ও হোস্টেলে শিশুদের নিজেদের পরিচালিত চিলড্রেন ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকসহ বিভিন্ন ব্যাংকে তারা টাকা জমায়। শৈশব পার হতে হতে স্বাবলম্বী হয়ে যায়। পরে নিজস্ব ছকে চলতে থাকে তাদের জীবন।