নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ উপজেলায় লোহা গলানোর সময় চুল্লিতে বিস্ফোরণ হওয়া রহিমা ইন্ডাস্ট্রিয়াল কমপ্লেক্স লিমিটেড নামের কারখানাটির ছাড়পত্র নেই। নিরাপত্তা সরঞ্জাম ছাড়াই চলছিল কারখানাটির উৎপাদন। গতকাল বৃহস্পতিবার বিকেলে কারখানাটিতে বিস্ফোরণের পর এসব তথ্য জানা গেছে।
চুল্লিতে বিস্ফোরণের ঘটনায় গতকাল দিবাগত রাত ১২টা পর্যন্ত দুই শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে। তাঁরা হলেন লালমনিরহাটের পাটগ্রাম উপজেলার ইসলামনগর এলাকার ভোলা বাবুর ছেলে শঙ্কর বাবু (৩৭) ও কিশোরগঞ্জের ইটনা মৃধা আড়ি এলাকার ফজর আলীর ছেলে মো. ইলিয়াস হোসেন (৩৫)।
গুরুতর দগ্ধ হয়ে চিকিৎসাধীন আরও পাঁচ শ্রমিক। তাঁদের অবস্থাও সংকটাপন্ন বলে শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের আবাসিক সার্জন এস এম আইয়ুব হোসেন জানিয়েছেন।
দগ্ধ শ্রমিকেরা হলেন কিশোরগঞ্জের ইটনা সদর এলাকার আজাদ আলীর ছেলে মো. আলমগীর হোসেন (৩৩), লালমনিরহাটের পাটগ্রাম উপজেলার বেনকান্দা এলাকার ওলিউর রহমানের ছেলে গোলাম রাব্বানী (৩৫), রাজবাড়ি সদর উপজেলার রামকান্তপুর এলাকার আহাম্মদ মিয়ার ছেলে মো. নিয়ন (২০), বরিশালের বাবুগঞ্জ উপজেলার গজারিয়া এলাকার মোখলেছুর রহমানের ছেলে মো. ইব্রাহিম (৩৫) ও জুয়েল (২৫)। তাঁদের মধ্যে রাব্বির শরীরের ৯৮ শতাংশ, নিয়ন ও জুয়েল ৯৫ শতাংশ, আলমগীরের ৯০ শতাংশ এবং ইব্রাহিমের শরীরের ২৮ শতাংশ দগ্ধ হয়েছে।
কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর নারায়ণগঞ্জ কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, গত বছরের শেষে কারখানাটি ছাড়পত্রের জন্য অধিদপ্তরের নারায়ণগঞ্জ কার্যালয়ে আবেদন করে। তারপর কারখানা পরিদর্শক খালিদ হাসান ও মেহেদী হাসান দুই দফায় কারখানাটি পরিদর্শন করেন। কারখানার শ্রেণি ও কাজের ধরন অনুযায়ী, শ্রমিকদের ‘যথাযথ’ নিরাপত্তা না থাকায় তাঁরা কারখানাটিকে ছাড়পত্র না দিয়ে নিরাপত্তা জোরদারের সুপারিশ করেন।
দুই পরিদর্শক খালিদ হাসান ও মেহেদী হাসান প্রথম আলোকে জানান, সবশেষ গত ৬ মার্চ তাঁরা সরেজমিন কারখানা পরিদর্শনে গিয়েছিলেন। এ সময় কারখানার মেশিন লে-আউট, শ্রমিকদের কর্মপরিবেশ, শ্রমিকদের নিরাপত্তা পোশাক যথাযথ না হওয়ায় তাঁরা প্রথমে মৌখিক ও পরে লিখিতভাবে নিরাপত্তা নিশ্চিতের জন্য কারখানা কর্তৃপক্ষকে তাগিদ দিয়েছিলেন। কিন্তু কারখানাটি নিরাপত্তা নিশ্চিত না করেই পরীক্ষামূলকভাবে তাদের উৎপাদন চালাচ্ছিল।
গতকাল রাতে কারখানা পরিদর্শক মেহেদী হাসান মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘কারখানা ছাড়পত্রের জন্য আবেদনের পর চলতি বছর আমরা দুই দফায় কারখানাটি পরিদর্শন করি। উচ্চ ঝুঁকির কারখানা হিসেবে এ ধরনের কারখানাগুলোকে কতগুলো সতর্কতা অবলম্বন করতে হয়। এ ক্ষেত্রে তারা সেটি করতে ব্যর্থ হয়েছিল। সে কারণে আমরা কারখানা সনদ না দিয়ে শ্রমিকদের এবং কারখানার নিরাপত্তা নিশ্চিতের জন্য তাঁদের চিঠি দিয়েছিলাম। তার পর থেকে কারখানা কর্তৃপক্ষ পরীক্ষামূলক কার্যক্রম চালাচ্ছিল।’
দুই মাস আগে পরিদর্শনে গিয়ে আমরা শ্রমিকদের কোনো নিরাপত্তা পোশাক পরতে দেখিনি। তাদের অবকাঠামো সুসংহত ছিল না। উৎপাদনের প্রক্রিয়া অস্বাভাবিক ছিল।
গত ৬ মার্চ শেষবার কারখানাটি পরিদর্শন করা হয়েছে জানিয়ে মেহেদী হাসান বলেন, ‘সে সময় পরিদর্শনে গিয়ে আমরা শ্রমিকদের কোনো নিরাপত্তা পোশাক পরতে দেখিনি। তাদের অবকাঠামো সুসংহত ছিল না। উৎপাদনের প্রক্রিয়া অস্বাভাবিক ছিল। আমরা আমাদের পর্যবেক্ষণ তাদের জানানোর পর তাঁদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার কথা ছিল।’
অভিযোগের বিষয়ে রহিমা ইন্ডাস্ট্রিয়াল কমপ্লেক্স লিমিটেডের তত্ত্বাবধায়ক শফিকুল ইসলাম বলেন, ছয় মাস ধরে কারখানায় লোহা উৎপাদনের কাজ করা হচ্ছে। কারখানাটিতে সব ধরনের নিরাপত্তাব্যবস্থা আছে। শ্রমিকেরাও সেফটি জ্যাকেট (নিরাপত্তা পোশাক) পরিহিত ছিলেন। তিনি বলেন, বিস্ফোরিত উত্তপ্ত লোহার কারণে শ্রমিকেরা দগ্ধ হন।
গতকাল সাত শ্রমিক দগ্ধ হওয়ার ঘটনা শুনে আড়াইহাজার ফায়ার সার্ভিসের একটি দল ঘটনাস্থলে যায়। ঘটনাস্থল পরিদর্শন শেষে ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তা শহীদ আলমও কারখানাটির শ্রমিক নিরাপত্তার বিষয়ে কথা বলেছেন। ঘটনাস্থলে কোনো অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্র দেখতে পাননি উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘শ্রমিকদের যে ধরনের নিরাপত্তার সরঞ্জাম ব্যবহার করার কথা, সেগুলো ব্যবহার করা হয়নি বলে আমরা অভিযোগ পেয়েছি।’
শহীদ আলম বলেন, ‘এত বড় একটি ঘটনার পরও কারখানা কর্তৃপক্ষ ফায়ার সার্ভিসকে কিছুই জানায়নি। বিভিন্ন সূত্রে খবর পেয়ে আমরা ঘটনাস্থলে যাই। তখন কারখানা কর্তৃপক্ষ কিংবা শ্রমিকদের কাউকে আর সেখানে পাওয়া যায়নি।’
দুর্ঘটনার কারণ সম্পর্কে জানতে চাইলে ফায়ার সার্ভিসের এই কর্মকর্তা বলেন, ‘এটা তদন্তের বিষয়। তবে প্রাথমিকভাবে মনে হয়েছে চুল্লিতে নানা রকমের লোহা গলানোর সময় চুল্লির ভেতরে কোনো একটা কিছুর বিস্ফোরণ হয়েছে। বিস্ফোরণের পর গলিত লোহা ছিটকে এসে শ্রমিকদের শরীরে পড়ে।’ লোহা গলানোর ওই চুল্লিটি অক্ষত আছে বলে তিনি জানান।
বৃহস্পতিবার রাতে কারখানাটির দুই শ্রমিকের সঙ্গে কথা হলে কারখানার নিরাপত্তাব্যবস্থার দুর্বলতার কথা তাঁরাও জানিয়েছেন। এসব শ্রমিকের একজন প্রথম আলোকে বলেন, ‘এত বড় ঘটনার পরও কিছুই হবে না। এই কারখানা কেন, সব কারখানাতেই এমন কইরা কাম চলে। আমরাও পেটের তাগিদে কাম করি।’
নিজের সহকর্মীদের এমন ঘটনার পর নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কা তৈরি হলেও কারখানায় কাজ চালিয়ে যাওয়ার কথা বলেন এই শ্রমিক। তিনি বলেন, ‘যা কিছুই হোক, কাম করন লাগব। কোনো জায়গাতেই নিরাপত্তা নাই। এগুলো সব কাগজপত্রের বিষয়। এমন একটা ঘটনা ঘটলে কয়দিন এসব নিয়া আলোচনা হয়। তারপর সব আগের নিয়মেই চলে।’
রূপগঞ্জ থানায় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আজ শুক্রবার সকাল ৯টা পর্যন্ত এ ঘটনায় কোনো মামলা হয়নি। নারায়ণগঞ্জ জেলা পুলিশের জ্যেষ্ঠ সহকারী পুলিশ সুপার (রূপগঞ্জ-আড়াইহাজার সার্কেল) আবির হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘এ ঘটনায় একটি মামলার প্রস্তুতি চলছে। আমরা হতাহতদের স্বজনদের খোঁজ করছি। তাঁদের পক্ষ থেকেও যেন মামলা করা হয়, সে বিষয়টিও দেখছি।’