ষাটোর্ধ্ব আজাদ মিয়া নির্বাক তাকিয়ে আছেন। চোখে পানি নেই। পাশেই স্ত্রী জহুরা খাতুন ও মেয়ে ময়না খাতুন বুক চাপড়ে বিলাপ করছেন। একটু দূরে আজাদ-জহুরা দম্পতির ছেলে জাহাঙ্গীর হোসেন ও হৃদয় হোসেনও হাউমাউ করে কাঁদছেন। তাঁদের সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করছেন স্বজনেরা।
আজ শুক্রবার বেলা পৌনে একটার দিকে রাজধানীর শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে পোস্ট অপারেটিভ ইউনিটের বাইরের দৃশ্য এটি। এর মাত্র ১৫ মিনিট আগে চিকিৎসাধীন অবস্থায় আজাদ–জহুরা দম্পতির বড় ছেলে আলমগীর হোসেন (৩৩) মারা গেছেন।
এ শোক সইতে না পেরে ইনস্টিটিউটের পঞ্চম তলায় পোস্ট অপারেটিভ ইউনিটের বাইরে লিফটের সামনের ফাঁকা জায়গায় বসে এভাবেই বিলাপ করতে দেখা যায় আলমগীরের পরিবারের সদস্যদের।
গতকাল বৃহস্পতিবার বিকেল সাড়ে তিনটার দিকে নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের ভুলতায় রহিমা ইন্ডাস্ট্রিয়াল কমপ্লেক্স লিমিটেড নামের একটি স্টিল কারখানায় চুল্লি বিস্ফোরণ হয়। এতে দগ্ধ হন সাতজন। তাঁদের মধ্যে একজন আলমগীর হোসেন।
ওই দিন রাতে দগ্ধ ব্যক্তিদের শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে ভর্তি করা হয়। তাঁদের মধ্যে চিকিৎসাধীন অবস্থায় এ পর্যন্ত আলমগীরসহ চারজনের মৃত্যু হয়েছে। বিস্ফোরণে আলমগীরের শরীরের ৯৫ শতাংশ দগ্ধ হয়েছিল।
স্বজনেরা জানান, আলমগীরদের গ্রামের বাড়ি কিশোরগঞ্জের ইটনায়। জীবিকার তাগিদে প্রায় ৩০ বছর আগে আলমগীরের বাবা আজাদ মিয়া পরিবারকে নিয়ে নারায়ণগঞ্জের পাগলা এলাকায় আসেন। আজাদ মিয়া দিনমজুর। তাঁর স্ত্রী জহুরা বাসাবাড়িতে কাজ করেন। অর্থাভাবে ছয় সন্তানের কেউ পড়াশোনা করতে পারেননি।
কারখানাটি এখন নির্মাণাধীন। পরীক্ষামূলকভাবে লোহা গলানোর কাজ করা হচ্ছিল। বৃহস্পতিবার বিকেল সাড়ে তিনটার দিকে লোহা গলানোর চুল্লিতে বিকট শব্দে বিস্ফোরণ হয়। এতে গলিত উত্তপ্ত লোহা শ্রমিকদের শরীরে পড়ে।
চার ভাই ও দুই বোনের মধ্যে আলমগীর ছিলেন বড়। জহুরা খাতুন বিলাপ করতে করতে বলছিলেন, ‘আমারে বাবার কাছে নিয়া যাও। আমি বাবার মুখটা দেহুম।’
আলমগীরের ছোট ভাই জাহাঙ্গীর বলেন, তিনি সবজি বিক্রির কাজ করেন। বাবার বয়স হয়েছে। পরিবারে অভাব থাকায় তাঁর বাবা এখনো দিনমজুরের কাজ করেন। তাঁরা পাগলা এলাকায় ভাড়া থাকেন। আলমগীর বিয়ে করেছেন ১০ বছর আগে। সন্তান নেই। স্ত্রী গৃহিণী।
শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউট সূত্র জানায়, স্টিল কারখানায় বিস্ফোরণের ঘটনায় বৃহস্পতিবার দগ্ধ সাতজনকে হাসপাতালে আনা হয়। আনার পরই শঙ্কর (৪০) নামে এক শ্রমিক মারা যান। ইলিয়াস আলী (৩৫) নামের একজনেরও মৃত্যু হয় রাতে। মো. নিয়ন (২০) নামে আরেক শ্রমিক মারা যান শুক্রবার সকাল সাড়ে ১০টায়। দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে মারা যান আলমগীর। বর্তমানে চিকিৎসাধীন আছেন জুয়েল (২৫), রাব্বি (৩৫) ও ইব্রাহিম (৩৫)।
ইনস্টিটিউটের আবাসিক সার্জন আইয়ুব হোসেন প্রথম আলোকে জানান, চিকিৎসাধীন রাব্বির শরীরের ৯৮ শতাংশ, জুয়েলের ৯৫ শতাংশ ও ইব্রাহিমের ২৮ শতাংশ দগ্ধ হয়েছে। যে চারজন মারা গেছেন তাঁদের শরীরের ৯৫ থেকে ৯৮ শতাংশ পর্যন্ত দগ্ধ ছিল।
গতকাল বিকেলে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে ভুলতা পুলিশ ফাঁড়ির পরিদর্শক মোস্তাফিজুর রহমান জানান, কারখানাটি এখন নির্মাণাধীন। পরীক্ষামূলকভাবে লোহা গলানোর কাজ করা হচ্ছিল। বিকেল সাড়ে তিনটার দিকে লোহা গলানোর চুল্লিতে বিকট শব্দে বিস্ফোরণ হয়। এতে গলিত উত্তপ্ত লোহা শ্রমিকদের শরীরে পড়ে।