২৮ দিন পর যুক্তরাজ্যে ফের কৃষিপণ্য রপ্তানি শুরু

হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর
ফাইল ছবি

প্রায় এক মাস বন্ধ থাকার পর হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে কার্গো ভিলেজের এক্সপ্লোসিভ ডিটেকশন স্ক্যানার (ইডিএস) যন্ত্র সচল হয়েছে। ফলে বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাজ্যে সবজি রপ্তানি আবার শুরু হয়েছে। তবে ব্যবসায়ীরা বলছেন, দীর্ঘ এই বিরতির কারণে তাঁরা যুক্তরাজ্যের বাজারের অনেক অর্ডার হারিয়েছেন। এ সময় তাঁদের ১০৫ কোটি টাকার ওই বাজার পুনরুদ্ধার করা কঠিন হয়ে যাবে।

বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ ও ব্যবসায়ীরা বলছেন, বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজের একমাত্র সচল ইডিএস যন্ত্রটি দুই থেকে তিন মাস পরপরই নষ্ট হয়ে যায়। প্রতিবার নষ্ট হলে মেরামত করতে অন্তত দুই সপ্তাহ সময় লাগে। সর্বশেষ গত ১০ মার্চ যন্ত্রটি অকেজো হয়ে পড়ে। এর ফলে যুক্তরাজ্য ও ইউরোপের দেশগুলোতে কোনো কৃষিপণ্য পাঠানো যায়নি। অথচ কৃষিপণ্য রপ্তানির বড় বাজারটি যুক্তরাজ্য ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোকে ঘিরে।

বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক) বলছে, শাহজালাল বিমানবন্দরে কার্গো ভিলেজে দুটি এরিয়া রয়েছে। আরএথ্রি ও নন-আরএথ্রি। এর মধ্যে আরএথ্রি জায়গাটি ইউরোপীয় দেশগুলোয় পণ্য পাঠানোর জন্য। সেখানে আছে চারটি ইডিএস ও দুটি এক্স-রে স্ক্যানার যন্ত্র। এর মধ্যেএকটি ইডিএস পুরোপুরি বিকল, আরেকটি কয়েক মাস পরপর নষ্ট হয়। বাকি দুটি ইডিএস গত বছরের মার্চে বসানো হয়েছে। তবে যুক্তরাজ্যের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দ্বারা স্বীকৃত নয় বলে সেগুলো এত দিন চালু হয়নি। বিমানবন্দর সূত্র জানায়, সম্প্রতি সেগুলোর অনুমোদন পাওয়া গেছে। ৫ এপ্রিল এ–সংক্রান্ত মেইল এসেছে বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষের কাছে।

এদিকে ইউকে এভিয়েশন রেগুলেশন অনুযায়ী, ইডিএস যন্ত্রে স্ক্যানিং ছাড়া অন্য কোনো যন্ত্রে স্ক্যান করা কৃষিপণ্য দেশটিতে ঢুকতে দেওয়া হয় না।

হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নবনিযুক্ত নির্বাহী পরিচালক গ্রুপ ক্যাপ্টেন মোহাম্মদ কামরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, পুরোনো দুটি স্ক্যানার যুক্তরাজ্য কর্তৃপক্ষের অনুমোদন পেয়েছে। যেই ইডিএসটা নষ্ট (কিছুদিন পরপর নষ্ট হয়), সেটি মেরামতের কাজ চলছে। তিনি জানান, এর মধ্যেই দুটি শিপমেন্ট গেছে। এখন পুরোদমে কাজ করছে বিমানবন্দরের স্ক্যানারগুলো।

বেবিচক প্রতি কেজি কৃষিপণ্য রপ্তানিতে স্ক্যানিংয়ের জন্য ছয় সেন্ট করে মাশুল নেয়। এক সপ্তাহের মাশুলের অর্থ দিয়ে এ রকম চারটি স্ক্যানার যন্ত্র কেনা যায়। ইডিএস যন্ত্র ঠিক করতে বেবিচক গাফিলতি করছে। এভাবে ব্যবসা করা যায় না।
- মনসুর আহমেদ, সাধারণ সম্পাদক, বিএফভিএপিইএ

বাংলাদেশ ফুড ভেজিটেবলস অ্যান্ড অ্যালাইড প্রোডাক্ট এক্সপোর্ট অ্যাসোসিয়েশনের (বিএফভিএপিইএ) সভাপতি এস এম জাহাঙ্গীর হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, গতকাল বুধবার থেকে বিমানবন্দরের মাধ্যমে ইউরোপে পণ্য পাঠানো শুরু হয়েছে। আজ রাতেও পণ্য পাঠানো হবে। তবে এত দিন বন্ধ থাকায় আমাদের ব্যবসায়ীদের অনেক আর্থিক ক্ষতি হয়েছে।

প্রায়ই নষ্ট হয় স্ক্যানার

বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাজ্যে লতি, চালকুমড়া, পেঁপে, কলা পাঠান এনএইচবি করপোরেশেনের স্বত্বাধিকারী নাজমুল হায়দার। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিমানবন্দরে স্ক্যানার যন্ত্র নষ্ট হওয়ার পর থেকে আমার আটটি অর্ডার আসে। এগুলোর একটিও আমি পাঠাতে পারিনি। এতে আমার ১২ লাখ টাকার আর্থিক ক্ষতি হয়েছে।’

নাজমুলের মতো বিপাকে পড়েছেন আরও অনেক ব্যবসায়ী। তাঁরা জানান, শাহজালাল বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজে প্রায়ই স্ক্যানার নষ্ট হয়ে যায়। এ নিয়ে ব্যবসায়ীদের ক্ষোভ দীর্ঘদিনের। গত বছরের সেপ্টেম্বরের শেষের দিকে দুটি ইডিএস স্ক্যানার নষ্ট হয়। সে সময় কার্গো ভিলেজে ব্যাপক পণ্যজট হয়। সে সময় দীর্ঘায়িত হয় বিমানবন্দরের রপ্তানি প্রক্রিয়া।

যুক্তরাজ্যে লাউ, ঝিঙে, শজনে, চালকুমড়া, পটোল, শিম, কাঁঠাল, পেঁপে, বেলসহ বিভিন্ন ফল ও সবজি রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান লি এন্টারপ্রাইজ। প্রতিষ্ঠানটির স্বত্বাধিকারী মো. আবুল হোসাইন গতকাল রাতে প্রথম আলোকে বলেন, ‘গত ২৮ দিনে আমার দুটি অর্ডার এসেছে। কিন্তু পণ্য পাঠাতে পারিনি। ইউরোপের ক্রেতারা ভারত থেকে অর্ডার নিচ্ছেন।’

গত বছরের ২৯ সেপ্টেম্বর বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজ আকস্মিক পরিদর্শন করেন প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান। ওই সময় তিনি এ ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের গাফিলতি রয়েছে বলে মন্তব্য করে গণমাধ্যমকর্মীদের কাছে ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন।

ক্ষতি প্রায় শত কোটি টাকা

ব্যবসায়ী ও রপ্তানিকারকদের সংগঠন বাংলাদেশ ফুড ভেজিটেবলস অ্যান্ড অ্যালাইড প্রোডাক্ট এক্সপোর্ট অ্যাসোসিয়েশন (বিএফভিএপিইএ) জানিয়েছে, তাদের সংগঠনভুক্ত ২০০ সদস্যের হাত ধরে প্রতিদিন অন্তত ১২০ মেট্রিক টন পচনশীল কৃষিপণ্য বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হয়। এর মধ্যে ৮০ শতাংশ যায় যুক্তরাজ্যে। প্রতি কেজি পণ্য পাঠিয়ে তাঁরা গড়ে চার ডলার আয় করেন। এই হিসাবে ব্যবসায়ীদের অনুমান, গত ২৮ দিনে তাঁরা ১০৫ কোটি টাকার বেশি মূল্যের পচনশীল কৃষিপণ্য রপ্তানি করতে পারেননি।

বিএফভিএপিইএর হিসাবে, ২০১৯-২০ অর্থবছরে বাংলাদেশ থেকে ১ হাজার ৪১৯ কোটি টাকা মূল্যের ৮২ হাজার ৫১০ মেট্রিক টন ফল ও সবজি রপ্তানি করা হয়েছে। আর সর্বশেষ ২০২০-২১ অর্থবছরে বাংলাদেশ থেকে রপ্তানি হয়েছে ১ হাজার ২৯ কোটি টাকা মূল্যের ৬০ হাজার ৮৮৯ মেট্রিক টন ফল ও সবজি।

অভিযোগ বেবিচকের বিরুদ্ধে

টানা ২৮ দিন ধরে বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজে স্ক্যানার না থাকা ও পচনশীল কৃষিপণ্যের রপ্তানি পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বেবিচকের গাফিলতি দেখছেন ব্যবসায়ীরা। এ বিষয়ে বিএফভিএপিইএর সাধারণ সম্পাদক মনসুর আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, একটি স্ক্যানার যন্ত্র দুই বছর ধরে নষ্ট। আরেকটি কয়েক দিন পরপর নষ্ট হয়। এতে লোকসান হচ্ছে ব্যবসায়ীদের, দেশের।

মনসুর আহমেদ আরও বলেন, ‘বেবিচক প্রতি কেজি কৃষিপণ্য রপ্তানিতে স্ক্যানিংয়ের জন্য ছয় সেন্ট করে মাশুল নেয়। এক সপ্তাহের মাশুলের অর্থ দিয়ে এ রকম চারটি স্ক্যানার যন্ত্র কেনা যায়। ইডিএস যন্ত্র ঠিক করতে বেবিচক গাফিলতি করছে। এভাবে ব্যবসা করা যায় না। এর ফলে ভারত, শ্রীলঙ্কা, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়ার কাছে আমরা রপ্তানি বাজার হারাব। আমাদের কিছুই করার থাকবে না। বেবিচককে বারবার চিঠি দিয়েও কোনো লাভ হয়নি।’

শাহজালাল বিমানবন্দরের সদ্য বিদায়ী নির্বাহী পরিচালক গ্রুপ ক্যাপ্টেন এ এইচ এম তৌহিদ-উল আহসান আজ সন্ধ্যায় প্রথম আলোকে বলেন, ‘ইডিএস যন্ত্র নষ্ট হওয়ার পরপর আমরা দ্রুতই তা মেরামতের উদ্যোগ নিয়ে থাকি, চিঠি দিয়ে বেবিচককে জানানো হয়। কিন্তু এসব যন্ত্রের যন্ত্রাংশ বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। সেসব যন্ত্র দেশে আনতে কিছুটা সময় লাগে। এখানে বেবিচকের গাফিলতির সুযোগ নেই।’