ঈদযাত্রায় স্বস্তি যে কারণে

মহাসড়ক এখন অনেকটাই ফাঁকাফাইল ছবি: প্রথম আলো

করোনার কারণে গত দুই বছর অনেকেই গ্রামে ঈদ করতে যাননি। এবার করোনার শঙ্কা না থাকায় দ্বিগুণ মানুষ ঢাকা ছাড়তে পারেন এবং এতে দীর্ঘ যানজট, দুর্ঘটনা বৃদ্ধি ও ভোগান্তিতে ভয়ংকর পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছিল। তবে এবার গ্রামে ফেরা নিয়ে কিছুটা ভোগান্তি ও কিছু দুর্ঘটনা হলেও অন্যান্যবারের মতো পরিবহন ব্যবস্থায় ভয়ংকর পরিস্থিতি দেখা যায়নি।

প্রথম আলোর একটি জরিপ থেকেও ঈদযাত্রায় স্বস্তির আভাস পাওয়া যায়। গত ৩০ এপ্রিল সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ‘অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে এবার দেশের সড়ক ও মহাসড়কের অবস্থা ভালো। মনে হয়, এবারের ঈদযাত্রা স্বস্তিতেই কাটবে।’ এই বক্তব্য তুলে ধরে প্রথম আলোর একটি জরিপে প্রশ্ন করা হয়েছিল ‘ওবায়দুল কাদেরের এই বক্তব্যের সঙ্গে আপনি কি একমত?’। জরিপে যতজন অংশ নিয়েছেন, তাদের মধ্যে ৭৩ শতাংশ মনে করেন, ঈদযাত্রা স্বস্তিতে কাটবে। ২৫ শতাংশ মনে করেন, স্বস্তিতে কাটবে না। বাকি ২ শতাংশ উত্তরদান থেকে বিরত থাকেন।

যে শঙ্কা করা হয়েছিল

ঈদযাত্রা সামনে রেখে ১৭ এপ্রিল রাজধানীর সেগুনবাগিচায় ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে একটি সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করেছিল যাত্রী কল্যাণ সমিতি। সেখানে তারা আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেছিল, করোনার কারণে গত দুই বছর অনেকেই গ্রামে না যাওয়ায় এবার পবিত্র ঈদুল ফিতরে প্রায় দ্বিগুণ মানুষ ঢাকা ও আশপাশের এলাকা ছাড়তে পারেন। যানজট ও নানা অব্যবস্থাপনার কারণে গণপরিবহনে সুষ্ঠু ব্যবহার নিশ্চিত করা না গেলে এবারের ঈদযাত্রায় ভয়ংকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে। ঢাকার বিষয়ে সংগঠনটি বলেছিল, ২৫ রমজান থেকে ঈদের আগের দিন পর্যন্ত দুপুরের পর থেকে গভীর রাত অবধি রাজধানী অচল হয়ে যেতে পারে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে সোমবার যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী প্রথম আলোর কাছে দাবি করেন, ভয়ংকর পরিস্থিতি সৃষ্টি না হওয়ার ক্ষেত্রে যাত্রী কল্যাণ সমিতি ও গণমাধ্যম ভূমিকা রেখেছে। এই বক্তব্যের পক্ষে যুক্তি তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘আমরা যে শঙ্কার কথা বলেছিলাম, তা সরকারের দৃষ্টিতে এসেছে। আমরা দেখেছি, স্বরাষ্ট্র, সড়ক ও নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয় আলাদাভাবে সভা করেছে। যেসব সংকট ও সমাধানের কথা বলেছিলাম, এই প্রথমবারের মতো লক্ষ করেছি, সেগুলোকে তারা চিহ্নিত করার চেষ্টা করেছে।’

সেই সংবাদ সম্মেলনে অংশ নিয়েছিলেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের (এআরআই) পরিচালক মো. হাদিউজ্জামান। তিনি সেখানে পরিসংখ্যান দিয়ে বলেছিলেন, ঈদের আগের ৪ দিনে ১ কোটি ২০ লাখ মানুষ ঢাকা ছাড়বেন। অর্থাৎ প্রতিদিন গড়ে ৩০ লাখ মানুষ গ্রামে যাবেন। তার মধ্যে প্রতিদিন প্রায় ১৬ লাখ মানুষকে পরিবহনের ব্যবস্থা আছে। বাকি প্রায় ১৪ লাখ মানুষকে যেতে হবে ট্রেন–লঞ্চের ছাদে, কাভার্ড ভ্যান, ট্রাক, মোটরসাইকেল ও অন্যান্য ছোট যানবাহনে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায়। তিনি বলেছিলেন, এবার চাহিদা বেশি হওয়ায় সড়কের ব্যবস্থাপনা কোমায় চলে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে সোমবার বুয়েট অধ্যাপক হাদিউজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, বিষয়টি নিয়ে কিছুটা ভুল–বোঝাবুঝি আছে। এখানে দুটি জিনিস। একটি যানবাহন ব্যবস্থাপনা, অন্যটি অবকাঠামো ব্যবস্থাপনা। সরকার অবকাঠামো ব্যবস্থাপনায় শতভাগ সফল। কিন্তু যানবাহন ব্যবস্থাপনায় ব্যর্থ হয়েছে।
ব্যর্থতার বিষয়টি ব্যাখ্যা করে হাদিউজ্জামান বলেন, ‘আমি বলেছিলাম, ঈদে ৫০ শতাংশ মানুষের যানবাহনের ভালো ব্যবস্থা থাকবে। বাকি ৫০ শতাংশ বিকল্প খুঁজে নেবে। কারণ, তাদের জন্য সঠিক ব্যবস্থাপনা থাকবে না। এটা সত্য প্রমাণিত হয়েছে।’

অধ্যাপক হাদিউজ্জামান বলেন, যানবাহন না পেয়ে অসংখ্য মানুষ ট্রাকে, কাভার্ড ভ্যানে গেছে। যেসব বাস ঢাকা শহরের মধ্যে চলে, তারা উত্তরবঙ্গে চলে গেছে। শিমুলিয়া ফেরিঘাটে রেকর্ডসংখ্যক ভাঙা মোটরসাইকেল দেখা গেছে। বাসের টিকিটের দাম দুই থেকে আড়াই গুণ বেশি নিয়েছে। ট্রেনের টিকিট কালোবাজারি হয়েছে। ট্রেনের টিকিট পাওয়ার পর ট্রেনে উঠতে পারেনি। অনেকে ট্রেনে উঠলেও সিট পর্যন্ত যেতে পারেনি। ট্রাক ও বাল্কহেড ঈদের আগে পড়ে বন্ধ থাকার কথা ছিল, কিন্তু থাকেনি। এর মধ্যে সদরঘাটে এক যাত্রী পা হারিয়েছেন।

উন্নতি যেসব জায়গায়

অন্যবারের মতো এবার যানজট হয়নি বলে মনে করেন বুয়েট অধ্যাপক হাদিউজ্জামান। তিনি বলেন, অন্যবারের মতো যানজট হয়নি, এটা সত্য। কিন্তু একেবারেই হয়নি, এটা ঠিক নয়। চন্দ্রা থেকে এলেঙ্গা পর্যন্ত আগে যে ভোগান্তি হতো, সেটা এবার হয়নি। কিন্তু এলেঙ্গা থেকে যমুনা সেতু, সেতু থেকে হাটিকামরুল মোড়—এসব জায়গায় যানজট রয়েছে। উত্তরবঙ্গের জেলায় যেতে অন্যান্য ঈদে ১৮ থেকে ২০ ঘণ্টা লাগত। কখনো কখনো এর চেয়ে বেশি লেগেছে। তবে এবার কম লাগছে।

ভোগান্তি কিছুটা কম হওয়ার কারণ ব্যাখ্যা করে অধ্যাপক হাদিউজ্জামান বলেন, হাইওয়ে পুলিশ, এপিবিএন সদস্য এবং সড়ক ও মহাসড়ক অধিদপ্তরের যে ব্যবস্থাপনা ছিল, তার ফলে বিশৃঙ্খলা তৈরি হয়নি। দুই লেনের রাস্তার মাঝখানে বাঁশ দিয়ে অস্থায়ী সড়ক বিভাজক তৈরি করা হয়েছে। একটু যানজট হলে যানবাহন উল্টো রাস্তা দিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। এতে বিশৃঙ্খলা বেড়ে যায়। অস্থায়ী সড়ক বিভাজক তৈরি করায় এবার সেই বিশৃঙ্খলা তৈরি হয়নি। ফলে মানুষগুলো একটু স্বস্তি পেয়েছে।

এই ঈদে ৯ দিন ছুটি রয়েছে। ফলে মানুষ গ্রামে যাওয়ার জন্য বেশি সময় পেয়েছে। আবার অনেকেই আগেভাগে তাদের পরিবারকে গ্রামে পাঠিয়ে দিয়েছে। যানজট কম হওয়ার ক্ষেত্রে এই বিষয় দুটিও ভূমিকা রেখেছে বলে মনে করেন বুয়েটের এই অধ্যাপক।

যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, মহাসড়কে এবার কোনো ধরনের থ্রি–হুইলার, ইজিবাইক স্থান দেওয়া হচ্ছে না। এ কারণে মহাসড়কগুলোয় যানজট কম।

২৯ এপ্রিল গাবতলীতে বাস টার্মিনালে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছিলেন, ‘উত্তরবঙ্গের দিকে সব সময় যে সমস্যা হয়, আমরা সেটা কাটিয়ে উঠেছি। সেখানে নলকা ছিল দীর্ঘদিনের একটা সমস্যা। আমরা নলকা সেতু করে ফেলেছি।

কাজেই সেখানে কোনো সংকট হবে বলে আমার মনে হয় না। আর গাজীপুরের যে সমস্যা ছিল, আমার মনে হয়, এবার আর সেই সংকট হবে না। আমরা তিনটা উড়ালসড়ক খুলে দিয়েছি গাজীপুরে। সেখানে এখন নিয়মিত গাড়ি চলছে। অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে এবার সড়ক ভালো আছে।’

সামনে যে শঙ্কা

ঈদ শেষে ঢাকায় ফেরার সময় যানবাহন ব্যবস্থাপনা নিয়েও শঙ্কা প্রকাশ করেছেন বুয়েট অধ্যাপক হাদিউজ্জামান। তিনি বলেন, আসার সময় যানবাহন ব্যবস্থাপনা কোমায়ই থাকতে পারে। যাওয়ার সময় লম্বা সময় ছিল। সে জন্য যাঁদের অফিস–আদালত আছে, তাঁরা আগে চলে আসেন। পরিবার–পরিজন পরে আসুক।

যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী মনে করেন, ঈদের আগে সব সংস্থা রাস্তায় সক্রিয় থাকে। তবে ঈদের পরে সেখানে একটু উদাসীনতা দেখা যায়। যে কারণে সড়ক দুর্ঘটনা বেড়ে যায়। আসার সময় সবাই যেভাবে রাস্তায় ছিলেন, আসার সময়ও যেন তাঁরা থাকেন, তাহলে স্বস্তিদায়ক ঈদযাত্রা পাওয়া যাবে।