‘ঈদ হবে কেমনে, হুল্লোড় করার মানুষটাই তো নাই’

হুমায়রা ও হামজার এখন সময় কাটে মুঠোফোনে বাবা মোহাম্মদ মোরসালিনের ছবি দেখে। নিউমার্কেট এলাকায় সংঘর্ষে নিহত হন মোরসালিন। গতকাল কামরাঙ্গীরচরে তাঁদের বাড়িতে
তানভীর আহাম্মেদ

মোহাম্মদ মুরসালিন সাত বছরের মেয়ে হুমায়রাকে ঈদের জন্য ঝকমকে দুটি জামা আর সাড়ে তিন বছরের ছেলে হামজাকে প্যান্ট-শার্ট কিনে দিয়েছিলেন। স্ত্রী আর মায়ের জন্যও কেনাকাটা করেছিলেন। শুধু নিজের জন্য কিছু কেনেননি। বলেছিলেন, সময় তো আছে। তবে ঈদ আসার আগে আর সেই সময় পাননি তিনি।

১৯ এপ্রিল মঙ্গলবার দুপুরে রাজধানীর চন্দ্রিমা মার্কেটের সামনের রাস্তায় নিউমার্কেটের ব্যবসায়ী-কর্মচারী পক্ষ এবং ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীদের মধ্যে সংঘর্ষে নিহত হন নিউ সুপারমার্কেটের দোকানকর্মী মুরসালিন।

গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে কামরাঙ্গীরচরে মুরসালিনের দুই রুমের ভাড়া বাসায় গিয়ে জানা যায়, স্ত্রী অনি আক্তার তাঁর শাশুড়িকে নিয়ে মগবাজারে বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির অফিসে গেছেন ব্যাংক অ্যাকাউন্ট করাসহ বিভিন্ন কাজের জন্য। বাসায় অন্যান্য স্বজনের সঙ্গে হুমায়রা ও হামজা ছিল।

ঈদের জামাকাপড় দেখতে চাইলে হুমায়রা দৌড়ে গিয়ে কাপড়ের ব্যাগটি আনে। নিজেই বের করে দেখাতে থাকে। জানায়, তারা দুই ভাইবোন বাবার সঙ্গে নিউমার্কেটে গিয়ে নিজেদের পছন্দে পোশাক কিনেছিল।

আরও পড়ুন
মোহাম্মদ মোরসালিন

বাবা মারা গেছেন বিষয়টি বুঝতে পারে হুমায়রা। বলল, বাবা আল্লাহর কাছে চইল্যা গেছে। ঈদের দিন নামাজ পড়ে বাবার জন্য দোয়া করবে বলেও জানাল। বাবার সঙ্গে কাটানো ঈদের কথা বলতে গিয়ে হুমায়রা বলল, বাবা তাদের ঈদের সেলামি দিয়ে ছোট ভাইকে নিয়ে ঈদের নামাজ পড়তে যেতেন। তারপর সেমাই খেয়ে ঘুরতে যেতেন। বাবা আদর করতেন কি না, জানতে চাইলে হুমায়রা বলল, ‘বাবা একটু ধমক দিলে কানতাম, তখন বাবা আদর করতেন।’

ষষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেছেন অনি আক্তার। মুরসালিন সম্পর্কে খালাতো ভাই ছিলেন। তাঁরা নিজেরা একে অপরকে পছন্দ করেছিলেন, তারপর ১৩ বছর আগে পারিবারিকভাবে বিয়ে হয় তাঁদের।

মুরসালিনের স্ত্রী অনি আক্তার মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, সবার জন্য ঈদের কেনাকাটা করলেও স্বামী নিজের জন্য কিছুই কিনতে চাননি। কেনার কথা বললে বলেন, সময় তো চলে যায়নি। ঈদের আগে মানুষটাই চলে গেলেন।

মুরসালিন ঈদে হইচই করতে পছন্দ করতেন। সেমাই, চিনিসহ সব বাজার করতেন। অনি আক্তার বললেন, ‘এইবার আর আমাদের ঈদ নাই। ঈদটা আর হবে কেমনে? হুল্লোড় করার মানুষটাই তো নাই।’

অনি আক্তার আফসোসের কথা বলছিলেন। ঘটা করে স্বামী ও ছেলে–মেয়ে নিয়ে চারজনের কোনো ছবি তোলা হয়নি। অনি বললেন, চারজনের একসঙ্গে কোনো ছবি নেই এ আফসোস আর পূরণ হবে না। স্বামী ঈদের জন্য যে থ্রিপিস কিনে দিয়েছিলেন, ঈদের দিন তা পরে স্বামীকে দেখাতে চেয়েছিলেন, তা–ও আর হলো না।

অনি বললেন, ‘শনিবার ও সোমবার আমরা কেনাকাটা করলাম। আর মঙ্গলবারই ঘটল ঘটনাটা। দুই দিন হাসপাতালে ছিলাম, কিন্তু স্বামীর কাছে পাঁচ মিনিটও থাকতে দেয় নাই ডাক্তারেরা। হাসপাতালে তো তাঁর কথা বলার কোনো ক্ষমতাই ছিল না। কোনো কথাই হলো না। ঈদের পরদিন কুমিল্লায় যাওয়ার কথা ছিল, তা–ও আর হলো না।’

এখন স্বামীকে ছাড়া ছোট ছোট দুই ছেলেমেয়েকে নিয়ে কীভাবে জীবন পাড়ি দেবেন তা জানেন না তিনি। বিভিন্ন গ্রুপ ও সংস্থার পক্ষ থেকে আর্থিকসহ বিভিন্ন সহায়তা পেয়েছেন, কিন্তু তা দিয়ে তো আর জীবন চলবে না।

২৬ বছর বয়সী অনি আক্তার বললেন, ‘সরকার আমার ছেলেমেয়েদের একটি মাথা গোঁজার ঠাঁই করে দিক। আসলে স্বামী হারানোর কোনো ক্ষতিপূরণ হয় না, আমি চাই যাঁদের জন্য আমার স্বামীকে মরতে হলো, তাঁদের কঠোর শাস্তি হোক।’