ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর কিছু ভাষায় পাঠ্যবই থাকলেও ব্যবহার কম

বাংলাদেশে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর অনেক ভাষা বিপন্ন হতে চলেছে এবং বেশ কিছু হারিয়ে গেছে। কিছু ভাষায় পাঠ্যবই থাকলেও ব্যবহার কম। এসব জাতিগোষ্ঠীর শিশুদের মায়ের ভাষায় পাঠলাভের সুযোগ সৃষ্টির পাশাপাশি ৩০টি জাতিগোষ্ঠীর ভাষায় পাঠ্যপুস্তক রচনা করতে হবে।

আজ বুধবার রাজধানীর মোহাম্মদপুরে আদিবাসী শিশুদের মাতৃভাষা শিক্ষাবিষয়ক গবেষণা প্রতিবেদন উপস্থাপনা অনুষ্ঠানে এসব কথা বলা হয়। ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মানবাধিকার নিয়ে কাজ করা সংস্থা কাপেং ফাউন্ডেশন এর আয়োজন করে। তারা ২০১৯ সালের জুলাই মাস থেকে ২০২০ সালের জুন মাস পর্যন্ত পাত্র, খাসি ও হাজং জাতিগোষ্ঠীর শিশুদের মধ্যে এ গবেষণা পরিচালনা করে।

গবেষণা প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক ফারহা তানজীম। গবেষণাপত্রে বলা হয়, দেশে অন্তত ৩০টি ভাষার অস্তিত্ব পাওয়া গেলেও শিক্ষাক্ষেত্রে ১১ জাতির ভাষা নিয়ে বিভিন্ন ধরনের কাজ হয়েছে। যার মধ্যে সরকারি উদ্যোগে প্রাক্–প্রাথমিক পর্যায়ে পাঁচটি ভাষার পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন করা হয়েছে। তবে এর বাইরে বিভিন্ন উন্নয়ন সংস্থা ও সংগঠন আরও কিছু ভাষায় পাঠ্যবই তৈরি করেছে। পাঠ্যপুস্তক প্রণয়নের ক্ষেত্রে সংখ্যায়, ক্ষমতায় ও শিক্ষায় এগিয়ে থাকা জনগোষ্ঠীগুলোই গুরুত্ব পেয়েছে।

প্রতিবেদনটিতে বলা হয়, বাংলাদেশে ৪০ শতাংশ হাজং শিশু প্রাথমিক পর্যায়ের পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষা ভালোভাবে শেষ করতে পারে না। এর কারণ, হাজংদের মাতৃভাষায় শিক্ষালাভের সুযোগ না থাকা।

খাসি ভাষা প্রসঙ্গে বলা হয়, বাংলাদেশে খাসি ভাষায় শিশুদের জন্য বই লেখা হলে তারা জাতির জনক এবং বাংলাদেশ সম্পর্কে জানতে পারবে। এ ছাড়া বলা হয়, পাত্রদের নিজেদের ভাষা নিঃস্ব হতে হতে হারিয়ে যাচ্ছে।

কাপেং ফাউন্ডেশনের তুলে ধরা কিছু উল্লেখযোগ্য সুপারিশ হচ্ছে—দেশের সব ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর নিজ নিজ মায়ের ভাষা লিখতে ও পড়তে শেখার সুযোগ সৃষ্টি জরুরিসহ মৌখিক ব্যবহারের ওপর জোর দেওয়া প্রয়োজন, সরকারি উদ্যোগেই সবার জন্য ভাষাশিক্ষার আয়োজন করা সম্ভব। পাশাপাশি বেসরকারি সংস্থাগুলোও এগিয়ে আসতে পারে। ৩০টি ভাষায় পাঠ্যপুস্তক রচনাসহ শিক্ষার ব্যবস্থা করা, নিজ নিজ ভাষার শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া, মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের সহায়তায় বিপন্ন ভাষা চিহ্নিত করে তা চর্চার ব্যবস্থা করতে হবে।

অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং বলেন, ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর বিষয়ে অনেক বেশি গবেষণা প্রয়োজন। তাদের মাতৃভাষায় যে পাঠ্যপুস্তক আছে তা কোনো কাজে আসছে না। এই মাতৃভাষা রক্ষার জন্য কিছু কাজ হয়েছে, আরও অনেক কাজ বাকি। ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মাতৃভাষা রক্ষা করতে হলে রাষ্ট্রীয় দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে হবে। রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে সংবেদনশীলতা প্রয়োজন।

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের উপসচিব ব্রেঞ্জন চাম্বুগং বলেন, সরকার কিছু সুযোগ–সুবিধা তৈরি করেছে। দেশের বিভিন্ন স্থানে সংস্কৃতি একাডেমি আছে। তবে শহরগুলোতে একটি করে শিল্প ও সংস্কৃতি বিভাগ হতে পারে।

দৈনিক সমকালের বিশেষ প্রতিনিধি রাজীব নূর বলেন, শিশুদের জন্য সহজবোধ্য পৃথিবী গড়তে হবে। তাদের প্রাক্‌–প্রাথমিক শিক্ষাকে ভীতিকর করা যাবে না। ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মাতৃভাষা রক্ষা করতে রাষ্ট্রের অর্থ–সংকট নেই। কিন্তু মস্তিষ্কের সংকট আছে।

অনুষ্ঠানে আলোচকরা বলেন, নিজ মাতৃভাষার প্রয়োগ না থাকলে তা শিখে লাভ নেই। স্থানীয় পর্যায়ে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর জনগণের চাকরির ক্ষেত্রে মাতৃভাষা জানা থাকলে অগ্রাধিকার দেওয়া প্রয়োজন। ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর লোকজন এখন পরিচয় সংকটে ভুগছেন। অনেকের শব্দভান্ডার কমে আসছে। যাদের ভাষা হারিয়ে যাচ্ছে, সেই গোষ্ঠীকেই তা রক্ষায় এগিয়ে আসতে হবে। এসব ভাষা টিকিয়ে রাখতে হলে দক্ষ প্রশিক্ষক প্রয়োজন। বেসরকারি সংগঠন প্রকল্পভিত্তিক কাজ করলেও টেকসই ব্যবস্থার জন্য সরকারকে উদ্যোগ নিতে হবে।

কাপেং ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক পল্লব চাকমা অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন। আরও বক্তব্য দেন ফাউন্ডেশনের প্রোগ্রাম ম্যানেজার উজ্জ্বল আজিম, পাত্র সম্প্রদায় কল্যাণ পরিষদের নির্বাহী পরিচালক গৌরাঙ্গ পাত্র, বাংলাদেশ জাতীয় হাজং সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক পল্টন হাজং, কুবরাজ আন্তঃপুঞ্জি উন্নয়ন সংগঠনের প্রতিনিধি হেলেনা তালাংসহ প্রমুখ।