গেরিলাযুদ্ধের স্মৃতিচারণা করলেন চার বীর মুক্তিযোদ্ধা
হেমন্তের সন্ধ্যায় ৫০ বছর আগের একাত্তরের সেই উত্তাল দিনগুলোতে ফিরে গেলেন তাঁরা। সেই সময়কার টগবগে চার তরুণ আলাপে আলাপে তুলে ধরলেন ছাত্র থেকে মুক্তিযোদ্ধা হওয়ার গল্প। পাকিস্তানি হানাদারদের বিরুদ্ধে মাঠে নামার আগে কীভাবে মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ নিলেন, কীভাবে ঢাকা আক্রমণ করলেন—সবকিছু যেন চোখের সামনে ভেসে উঠল। আলাপে একে একে উঠে এল আলতাফ মাহমুদ, রুমী, বদি, জুয়েল, আজাদ, বকর, হাফিজসহ অনেক সহযোদ্ধার নাম। শনিবার ‘ক্র্যাক প্লাটুন: ঢাকার মুক্তিযোদ্ধা’ শীর্ষক আলোচনা সভায় মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলো গল্পে গল্পে উঠে আসে। জ্ঞানতাপস আব্দুর রাজ্জাক ফাউন্ডেশন ‘বিদ্যাপীঠ বৈঠকি-অন্তরঙ্গ আলাপে গুণীজন’ নামের এই ভার্চ্যুয়াল আলাপের আয়োজন করে।
শুরুতেই বীর মুক্তিযোদ্ধা ফতেহ আলী চৌধুরী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থেকে মুক্তিযোদ্ধা হয়ে ওঠার ঘটনা বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, ‘সেক্টর কমান্ডার খালেদ মোশাররফ আমাদের নির্দেশ দেন, প্রতিরোধযুদ্ধ চলছে, এটা বিশ্বকে জানান দিতে হবে। বড় আক্রমণ করতে হবে। আমরা সেভাবে আক্রমণ করতে থাকি। কিন্তু আমাদের উপস্থিতি টের পেয়ে পাকিস্তানি বাহিনী ১৯৭১-এর ২৯ আগস্ট জুয়েল, রুমী, বদিসহ অনেককে ধরে নিয়ে যায়। আমার বাড়িতেও রেড হয়...।’
বীর মুক্তিযোদ্ধা ফতেহ আলী চৌধুরী আরও বলেন, সেই সময় তিনি শুনেছিলেন, রুমীকে অনেক নির্যাতন করেছিল পাকিস্তানি বাহিনী। তাই তিনি সিদ্ধান্ত নিয়ে রেখেছিলেন, ‘যদি কখনো ধরা পড়ি, তাহলে আত্মহত্যা করব।’
উত্তাল সেই সময়ে এপ্রিলের তৃতীয় সপ্তাহের দিকে, ঢাকা থেকে মতিনগরে যান বীর মুক্তিযোদ্ধা আলী আহমেদ জিয়াউদ্দিন ও বীর মুক্তিযোদ্ধা মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন। সেক্টর কমান্ডার খালেদ মোশাররফ ও মেজর হায়দারের সঙ্গে তাঁরা দেখা করেন। খালেদ মোশাররফ তাঁদের বলেন, ‘তোমরা দুজন এসেছ, ঢাকায় ফিরে যাও। যত দূর পারো বন্ধুদের নিয়ে আসো।’
ওই দিনগুলোর স্মৃতিচারণা করে বীর মুক্তিযোদ্ধা আলী আহমেদ জিয়াউদ্দিন বললেন, তাঁরা আবার দেশে ফিরে এলেন। তাঁর বাবা মুক্তিযুদ্ধের যাওয়া বুঝতে পেরে বললেন, ‘তোমাকে বাধা দিব না...।’ আলী আহমেদ জিয়াউদ্দিন বললেন, জুন থেকে আগস্ট পর্যন্ত ঢাকা শহর উত্তাল হয়ে উঠেছিল গেরিলা মুক্তিযোদ্ধাদের অপ্রতিরোধ্য আক্রমণে।
ঢাকা আক্রমণের কথা বারুদের মতো সবখানে ছড়িয়ে পড়ে। খালেদ মোশাররফই সর্বপ্রথম ক্র্যাক শব্দটি উচ্চারণ করেন। এভাবে ক্র্যাট প্লাটুন নামের উৎপত্তি হয়।
বীর মুক্তিযোদ্ধা নাসির উদ্দীন ইউসুফ বললেন, ক্র্যাক প্লাটুন নামটা নভেম্বরে শ্রুত হতে শুরু করে। তিনি তাঁর স্মৃতিচারণায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বায়তুল মোকাররম অপারেশনসহ ঢাকায় গেরিলাযোদ্ধাদের কয়েকটি দুর্ধর্ষ আক্রমণের কথা তুলে ধরেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আক্রমণের সময় পাকিস্তানি সৈন্যদের হাত থেকে বাঁচাতে তাঁর এক শিক্ষকের ভূমিকার কথাও তুলে ধরেন তিনি।
আলাপের একপর্যায়ে মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ কোন পথে আছে—তা নিয়ে হতাশা ব্যক্ত করেন বীর মুক্তিযোদ্ধা হাবিবুল আলম। তিনি বলেন, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে সাড়ে ৪ হাজার বই প্রকাশি হয়েছে, কিন্তু কতজন পড়েছে? তিনি মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতি নিয়েও ক্ষোভ প্রকাশ করেন।
চার মুক্তিযোদ্ধার এই স্মৃতিচারণা অনুষ্ঠানের শুরুতে বক্তব্য দেন আব্দুর রাজ্জাক ফাউন্ডেশনের পরিচালক বীর মুক্তিযোদ্ধা অধ্যাপক আহরার আহমেদ। তিনি বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের তথ্যনির্ভর, বস্তুনিষ্ঠ ইতিহাস আমরা এখনো পাইনি। এটা মুক্তিযোদ্ধাদের দোষ নয়, বরং গবেষণার এই শূন্যতা জাতিগতভাবে আমাদের বিভ্রান্ত করে।’
অনুষ্ঠানের শুরুতে ঢাকার মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক আলোকচিত্র প্রদর্শন করা হয়।
মুক্তিযুদ্ধের গেরিলা বাহিনীর সদস্যদের সংবর্ধনা
মুক্তিযুদ্ধে ক্র্যাক প্লাটুনের রাজধানীর ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে হামলা বাংলাদেশের স্বাধীনতার লড়াইতে সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলেছিল। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের খবরের মাধ্যমে সারা বিশ্বের মানুষ এদেশে পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে বাংলাদেশের রাজনৈতিক লড়াই সম্পর্কে জেনেছিল। জীবনকে হাতের মুঠোয় নিয়ে ক্র্যাক প্লাটুনের একদল অকুতোভয় তরুণ সেদিন অসাধ্যসাধন করেছিল। শনিবার রাজধানীর একটি হোটেলে ক্র্যাক প্লাটুনের সদস্যদের সংবর্ধনা ও এ বিষয়ে আয়োজিত সেমিনারের বক্তারা এসব মন্তব্য করেন।
অনুষ্ঠানের প্রথম পর্বে ‘জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিধন্য হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল ঢাকা শীর্ষক’ সেমিনার এবং মুক্তিযুদ্ধের সময় হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে গেরিলা অপারেশনে অংশ নেওয়া ‘ক্র্যাক প্লাটুনের’ বীর মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে সম্মাননা তুলে দেওয়া হয়। দ্বিতীয় পর্বে ছিল সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।
বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী মো. মাহবুব আলীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সেমিনারে মূল প্রবন্ধ পাঠ করেন মঈন গণি।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তৃতায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের সময় আমরা সব সময় মৃত্যুকে হাতে নিয়ে চলেছি। অদম্য সাহসের ওপর ভর করে দেশ স্বাধীন করতে পেরেছি বলে আমি গর্বিত। আমাদের অনেকের অনেক ক্ষোভ থাকতে পারে। কিন্তু আমরা দেশ স্বাধীন করেছি, নিজেদের ভাষায় কথা বলছি, নিজেরাই দেশ স্বাধীন করছি এবং অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়তে পেরেছি। ক্র্যাক প্লাটুনের সদস্যদের হাতে ক্রেস্ট তুলে দিতে পেরে আমি আজ গর্বিত।’
বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি র আ ম উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী বলেন, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে আলোচনা করতে গেলে শুধু স্বপ্ন ও অহংকারের বিষয়ে বললে চলবে না, ভিন্ন প্রেক্ষাপট থেকে ভাবতে হবে। স্বাধীনতার ৫০ বছর পরও এ দেশে একমুখী শিক্ষা চালু হয়নি। ফলে সমাজে এখনো পশ্চাদমুখিতা বিরাজমান।
সংবর্ধিত ক্র্যাক প্ল্যাটুনের কমান্ডার ও আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম কমিটির সদস্য মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া বীর বিক্রম বলেন, ‘একাত্তরের ৯ জুনের আগে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে তেমন খবর ছিল না। কিন্তু হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে সেই গ্রেনেড হামলা শোরগোল ফেলে দেয়। তখন আমাদের বয়স কম ছিল, বুঝতাম কম। আমাদের কাছে ওই হামলার নির্দেশ এসেছিল তাই জীবন বাজি ধরে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাম।’
আলোচনায় আরও অংশ নেন ক্র্যাক প্লাটুনের অন্যতম সদস্য হাবিবুল আলম, আলি আহমেদ জিয়াউদ্দীন, বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. মোকাম্মেল হোসেন ও বাংলাদেশ সার্ভিসেস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আব্দুল কাইয়ুম।