পুলিশের মামলা
ঘুষের টাকায় বদলে গেল মাদক ও চুরির ঘটনা
কাউকে মাদক মামলায় ফাঁসানোর ভয় দেখিয়ে, কাউকে মামলা থেকে বাঁচানোর বা জামিন করিয়ে দেওয়ার কথা বলে টাকা নেওয়ার অভিযোগ।
সম্প্রতি নয়জন আদালতে জবানবন্দিতে পুলিশের টাকা নেওয়ার কথা বলেছেন।
এ বিষয়ে ডিএমপি কমিশনারকে চিঠি পাঠান সিএমএম।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী তাঁরা। থাকেন রাজধানীর উত্তরা এলাকায়। গত ২৫ ডিসেম্বর ওই বাসায় অভিযান চালায় পুলিশ। মাদক, টাকাসহ তাঁদের আটক করা হয়। তবে তাঁদের বিরুদ্ধে কোনো মাদকের মামলা দেওয়া হয়নি। দেড় লাখ টাকা নিয়ে ডিএমপি অধ্যাদেশের একটি ধারায় (নন–জিআর মামলায়) তাঁদের গ্রেপ্তার দেখায় উত্তরা পশ্চিম থানা-পুলিশ। সেখানে পুলিশ অভিযোগ করে, আসামিরা রাস্তায় হইহল্লা ও চিল্লাপাল্লা করে জনসাধারণের শান্তি নষ্ট করে অপরাধ করেছেন। পরের দিন ২০০ টাকা জরিমানা দিয়ে আদালত থেকে ছাড়া পান তাঁরা।
আইনে পরিষ্কার করে বলা আছে, কোনোগুলো ডিএমপি অধ্যাদেশে নন–জিআর মামলা হবে। এর ব্যত্যয় আমরা জানতে পারলে জড়িত কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়ডিএমপি কমিশনার মোহা. শফিকুল ইসলাম
একইভাবে টাকা নিয়ে আরও তিনজনকে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) অধ্যাদেশের বিভিন্ন ধারায় গ্রেপ্তার দেখিয়েছে পুলিশ। এ ছাড়া আরও ব্যক্তিকে ফুটপাতে দোকান করার অপরাধে আটক করে টাকা নিয়ে ডিএমপি অধ্যাদেশে মামলা দেওয়া হয়।
আটক করার পর কাউকে মাদক মামলায় ফাঁসানোর ভয় দেখিয়ে, কাউকে মাদক ও চুরির মামলা থেকে বাঁচানোর, আবার কাউকে গ্রেপ্তারের পরের দিনই জামিন করিয়ে দেওয়ার আশ্বাস দিয়ে টাকা নেওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে।
গত ডিসেম্বর মাসে রাজধানীর উত্তরা, বনানী, ভাটারা ও ভাষানটেক থানা এলাকা থেকে মাদক, চুরি ও অন্যান্য অপরাধে জড়িত থাকার অভিযোগে ৯ জনকে আটক করা হয়। পরে ডিএমপি অধ্যাদেশের বিভিন্ন ধারায় তাঁদের গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতে পাঠায় পুলিশ। আদালতে ১০০ থেকে ২০০ টাকা জরিমানা দিয়ে বেরিয়ে আসেন সবাই। আদালত থেকে বেরিয়ে আসার পর ওই ৯ জন ব্যক্তির মধ্য থেকে ৬ জনের সঙ্গে কথা বলে প্রথম আলো। তাঁদের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের তিনজন শিক্ষার্থী প্রথম আলোকে বলেছেন, পুলিশ তাঁদের সঙ্গে অন্যায় করেছে। ভয় দেখিয়ে তাঁদের চারজন থেকে দেড় লাখ টাকা নিয়েছে।
বাসায় মাদক রয়েছে এই কথা বলে বাসার ভেতরে প্রবেশ করেন কয়েকজন পুলিশ সদস্য। আমাকে সঙ্গে নিয়ে পাঁচতলার বাঁ পাশের ফ্ল্যাটে অভিযান চালান তাঁরা। সেখান থেকে চার বোতল মদ, কিছু গাঁজাসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আসিফ আহম্মেদ, মো. রাফিউল্লাহ, মেহেদী হাসান ও হোসেন সুজাকে আটক করেন।আজাদ হোসেন
পুলিশ টাকা নিয়ে মাদক ও চুরির মামলা না দিয়ে ডিএমপি অধ্যাদেশে মামলা দিয়েছে বলে প্রথম আলোর কাছে স্বীকার করেছেন গ্রেপ্তার আরও দুজন। গ্রেপ্তার নয়জনই ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে জবানবন্দি দিয়ে পুলিশকে টাকা দেওয়ার কথা বলেছেন বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ডিএমপি কমিশনার মোহা. শফিকুল ইসলাম গত সোমবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘আইনে পরিষ্কার করে বলা আছে, কোনোগুলো ডিএমপি অধ্যাদেশে নন–জিআর মামলা হবে। এর ব্যত্যয় আমরা জানতে পারলে জড়িত কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়।’
মাদক পাওয়ার কথা স্বীকার করল পুলিশ
গত ২৪ ডিসেম্বর দিবাগত রাত ১টা। বাসার মেইন গেট বন্ধ করে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন রাজধানীর উত্তরা ১৩ নম্বর সেক্টরের ১১ নম্বর রোডের ৬১ নম্বর বাসার দারোয়ান আজাদ হোসেন। ডাকাডাকির শব্দে শুনে রুম থেকে বেরিয়ে আসেন তিনি। আজাদ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘বাসায় মাদক রয়েছে এই কথা বলে বাসার ভেতরে প্রবেশ করেন কয়েকজন পুলিশ সদস্য। আমাকে সঙ্গে নিয়ে পাঁচতলার বাঁ পাশের ফ্ল্যাটে অভিযান চালান তাঁরা। সেখান থেকে চার বোতল মদ, কিছু গাঁজাসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আসিফ আহম্মেদ, মো. রাফিউল্লাহ, মেহেদী হাসান ও হোসেন সুজাকে আটক করেন।’
এই অভিযানে ছিলেন থানার পরিদর্শক (অপারেশন) পার্থপ্রতিম ব্রহ্মচারী ও উপপরিদর্শক (এসআই) মোহাম্মদ রায়হান উদ্দিন ও সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) নাজমুল ইসলাম। ভুক্তভোগীরা আদালতে জবানবন্দিতে বলেছেন, বাড়িওয়ালার সঙ্গে তাঁদের ঝামেলা ছিল। যার জেরে পুলিশ তাঁদের ফ্ল্যাটে ঢোকে। সেখান থেকে কিছু ডিভাইস ও ৪৭ হাজার টাকাসহ তাঁদের থানায় নিয়ে যায়। সেখানে নিয়ে আরও এক লাখ টাকা দাবি করে। টাকা না দিলে ৫০০ ইয়াবাসহ ফাঁসানোর ভয় দেখায় পুলিশ। পরে চারজনের পরিবার রাতের মধ্যে ১ লাখ ৩ হাজার টাকা দিলে তাঁদের মাদক মামলা না দিয়ে ডিএমপি অধ্যাদেশের ৭৭ ধারায় আদালতে চালান দেওয়া হয়।
মাদকসহ চার শিক্ষার্থীকে আটকের কথা প্রথম আলোর কাছে স্বীকার করেন উত্তরা পশ্চিম থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শাহ আক্তারুজ্জামান ইলিয়াস। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, গাঁজাসহ চারজনকে আটক করা হয়। তবে শিক্ষার্থী বিবেচনায় ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনা করে তাঁদের বিরুদ্ধে নন–জিআর মামলা দেওয়া হয়। তবে টাকা নেওয়া ও মদ উদ্ধারের বিষয়টি অস্বীকার করেন তিনি।
ওই চার শিক্ষার্থীদের মধ্যে আসিফ আহম্মেদ, মেহেদী হাসান ও হোসেন সুজা প্রথম আলোকে বলেন, পুলিশ তাঁদের সঙ্গে অন্যায় করেছে। তবে ভবিষ্যতে পুলিশের হয়রানির ভয়ে এর বেশি কিছু বলতে রাজি হননি তাঁরা। তবে বাসা থেকে মাদক উদ্ধারের কথা অস্বীকার করেছেন।
গত ৩১ ডিসেম্বর মহাখালীর আইপিএইচ স্কুল অ্যান্ড কলেজের সামনে থেকে গাঁজাসহ রফিকুল ইসলাম নামের এক যুবককে আটক করে বনানী থানা-পুলিশ। আদালতে জবানবন্দিতে রফিকুল বলেন, আটকের পর মাদক ও জাল টাকার মামলা দেওয়ার কথা বলে তাঁর কাছে থাকে সাড়ে তিন হাজার টাকা নেন এসআই মিজানুর রহমান। রাতে থানায় নিয়ে রফিকুলের মায়ের কাছ থেকে আরও ১৫ হাজার টাকা নেন তিনি। টাকা নিয়ে পরের দিন তাঁকে ডিএমপি অধ্যাদেশে গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতে পাঠায় পুলিশ।
রফিকুল ইসলাম সপরিবার থাকেন মহাখালীর সাততলা বস্তিতে। মা রাবেয়া বেগমের সঙ্গে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার ছেলে নেশা করে সেটা অস্বীকার করব না। পুলিশ ছেলেকে আটক করে থানায় নিয়ে টাকা চায়। ছেলের কথা চিন্তা করে রাতের ভেতর আত্মীয়স্বজনের কাছ থেকে ১৫ হাজার টাকা এনে মিজান স্যারকে দিয়েছি।’
টাকা নেওয়ার কথা অস্বীকার করেন এসআই মিজানুর রহমান। তিনি প্রথম আলোর কাছে দাবি করেন, রাতে সন্দেহজনক ঘোরাফেরা দেখে রফিকুলকে আটক করা হয়। পরে ডিএমপি অধ্যাদেশে মামলা দিয়ে আদালতে পাঠানো হয়েছিল।
মেট্রোরেলের লোহা চুরির ঘটনাও ধামাচাপা
বনানীর কাকলী এলাকায় মেট্রোরেল প্রকল্পের কাজ চলছে। সেখান থেকে লোহা চুরি করার অভিযোগে গত ২৯ ডিসেম্বর রাত একটার দিকে মোহাম্মদ হোসেন নামের ঢাকা সিটি করপোরেশনের এক পরিচ্ছন্নতাকর্মীকে (অস্থায়ী) আটক করে পুলিশ। টাকা নিয়ে তাঁকে চুরির মামলা না দিয়ে ডিএমপি অধ্যাদেশে ৬৯ ধারায় আদালতে পাঠায় পুলিশ। জরিমানা দিয়ে আদালত থেকে ছাড়া পান তিনি।
মোহাম্মদ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘মেট্রোরেল প্রকল্প থেকে এক টুকরা লোহার রড নিয়েছিলাম। বনানী থানার এসআই আবদুস সামাদ আমাকে জামিন করিয়ে দেওয়ার কথা বলে ১২০০ টাকা নেন।’ এ কথা তিনি আদালতকেও বলেছেন বলে জানান।
টাকা নেওয়ার অভিযোগ প্রসঙ্গে জানতে এসআই আবদুস সামাদের মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হয়। তিনি প্রতিবেদকের পরিচয় জানার পর ফোন কেটে দেন। পরে বিভিন্ন সময়ে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি।
জামিনের কথা বলে টাকা আদায়
ফুটপাতে দোকান করার অপরাধে দুজনকে আটক করে ভাটারা থানা-পুলিশ। গত ২৯ ডিসেম্বর রাতে যমুনা ফিউচার পার্কের সামনে থেকে ফুচকা বিক্রেতা জজ মিয়াকে আটক করা হয়। এদিন ভাটারার জগন্নাথপুর এলাকা থেকে মো. সুমন নামের আরেক হকারকে আটক করা হয়। ভাটারা থানার এসআই মোহাম্মদ আলী সৈকত তাঁদের গ্রেপ্তার করেন। পরের দিন আদালত থেকে ছাড়া পান সবাই।
আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতে জজ মিয়া বলেন, ‘ভাটারা থানার এসআই সৈকত স্যার আমাকে জামিন করিয়ে দেওয়ার কথা বলে ১১০০ টাকা নেন।’ মো. সুমন বলেন, গ্রেপ্তারের পর জামিন করিয়ে দেওয়ার কথা বলে এসআই সৈকত তাঁর কাছ থেকে ৫ হাজার টাকা নিয়েছেন।
এসআই মোহাম্মদ আলী সৈকত প্রথম আলোর কাছে দাবি করেন, ফুটপাতে দোকান করতে না দেওয়ার কারণে তাঁর বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ এনেছেন এসব ব্যক্তি।
এ ছাড়া গত ২২ ডিসেম্বর রাজধানীর ভাষানটেক এলাকা থেকে পুলিশ দেলোয়ার হোসেন নামের এক ব্যক্তিকে আটক করে। তাঁকে আদালত থেকে ছাড়িয়ে দেওয়ার কথা বলে এসআই সজল দেড় হাজার টাকা নেন। আদালতে জবানবন্দিতে তিনি এ অভিযোগ করেন।
গ্রেপ্তার এসব ব্যক্তির জবানবন্দি গ্রহণকারী দুই মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট এ বিষয়ে লিখিতভাবে চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেটকে (সিএমএম) জানান। তাতে বলা হয়, বিভিন্ন থানায় দালাল চক্রের সদস্যরা রয়েছেন। তাঁরা আসামিদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে আদালতে চালান করেন। সিএমএম আদালতে ডিএমপি অধ্যাদেশের বিভিন্ন ধারায় চালানকৃত এসব ঘটনা তদন্ত করে জড়িতদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ করা হয়। এ বিষয়ে গত ৩০ ডিসেম্বর ডিএমপি কমিশনার শফিকুল ইসলাম বরাবর সিএমএম একটি চিঠি পাঠান বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শাহদীন মালিক প্রথম আলোকে বলেন, জনমনে এই ধারণা প্রবলভাবে তৈরি হয়েছে যে অপরাধ করে হাতেনাতে ধরা পড়লেও পুলিশকে যথেষ্টভাবে খুশি করলে ছেড়ে দেয় অথবা লঘু ধারায় মামলা দেয়। এই ধারণা পাল্টানোর মতো পরিবেশ তৈরির উদ্যোগ পুলিশকেই নিতে হবে।