টাকা দিয়েছেন যুবক বয়সে, ফ্ল্যাট হলো না বৃদ্ধ বয়সেও

রাজধানীর মোহাম্মদপুরের রিং রোড এলাকার এফ ব্লকে জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষের তৈরি করা ফ্ল্যাট বুঝে পেতে মানববন্ধন করেছেন ২৪ বছর আগে টাকা জমা দেওয়া একদল মানুষ
ছবি: প্রথম আলো

এক খণ্ড জমি পেতে মোহাম্মদ আইয়ুব ১৯৯৭ সালে যখন সরকারি কোষাগারে টাকা জমা দিয়েছিলেন, তখন তাঁর বয়স ছিল ৩৩ বছর। এখন তাঁর বয়স ৫৭ বছর। গত ২৪ বছরেও সরকারি ওই প্লট বুঝে পাননি তিনি। আক্ষেপ করে আইয়ুব প্রথম আলোকে বললেন, প্লট পেতে যুবক বয়সে তিনি টাকা জমা দিয়েছিলেন। কিন্তু বৃদ্ধ বয়সে এসেও বুঝে পাননি। তিনি কারও কাছে দয়া চাচ্ছেন না। তাঁর প্রাপ্য বুঝে পেতে চান।

রাজধানীর মোহাম্মদপুরের রিং রোড এলাকার এফ ব্লকে জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষের প্লট পেতে অনেকেই ১৯৯৭ সালে টাকা জমা দিয়েছিলেন। এর মধ্যে এখনো ১৪৩ ব্যক্তি তাঁদের প্লট বুঝে পাননি। এর প্রতিবাদে আজ শুক্রবার মোহাম্মদপুরের এফ ব্লকে নির্মিত ভবনের সামনে মানববন্ধন করেছেন ভুক্তভোগীরা।

সেখানেই কথা হয় মোহাম্মদ আইয়ুবের সঙ্গে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষের বিজ্ঞপ্তির পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৯৭ সালে স্বল্প ও মধ্যম আয়ের লোকদের জন্য মোহাম্মদপুর এফ ব্লকে ২ দশমিক ৫ কাঠার প্লট পেতে ৩০ হাজার টাকা জামানতসহ আবেদন করেছিলেন। ১৩ বছর পর ২০১০ সালে সেখানে প্লটের পরিবর্তে ফ্ল্যাট করার সিদ্ধান্ত নেয় গৃহায়ণ। তখন ফ্ল্যাটের জন্য নির্ধারণ করে দেওয়া টাকা জমা দেন তিনি। এখন পর্যন্ত দিয়েছেন ১৭ লাখ ৫০ হাজার টাকা। কিন্তু দখল বুঝে পাননি।

আইয়ুবের মতো অনেকেই তাঁদের ফ্ল্যাট বুঝে পেতে রাস্তায় দাঁড়িয়েছিলেন। তাঁরা জানান, মোহাম্মদপুরের এফ ব্লকে প্রথমে প্লট বিক্রির বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হলেও বেশি লোকের সংস্থান করার জন্য ২০০৯ সালে সেখানে ফ্ল্যাট নির্মাণ করার ঘোষণা দেওয়া হয়। এর এক বছর পর ২০১০ সালে ৮০০ বর্গফুট ফ্ল্যাটের জন্য ৩০ লাখ টাকা এবং ১০০০ বর্গফুট ফ্ল্যাটের জন্য ৩৫ লাখ টাকা দর ঠিক করে নতুন করে দরখাস্ত আহ্বান করা হয়। এতে বলা হয়, আগ্রহী ব্যক্তিদের ৮০০ বর্গফুট ফ্ল্যাটের জন্য অর্ধেক মূল্য ১৫ লাখ টাকা এবং ১০০০ বর্গফুট ফ্ল্যাটের জন্য অর্ধেক মূল্য ১৭ লাখ ৫০ হাজার টাকা দখল বুঝে পাওয়ার আগেই পরিশোধ করতে বলা হয়। বাকি টাকা ১৫ বছরে পরিশোধের কথা জানায় গৃহায়ণ। কর্তৃপক্ষ তখন ঘোষণা দিয়েছিল, ফ্ল্যাট বুঝিয়ে দেওয়া হবে ৪ বছরের মধ্যেই তথা ২০১৪ সালে। এই সময়ের মধ্যে তাঁরা অর্ধেক টাকা জমা দিয়েছেন। কিন্তু ফ্ল্যাট আর বুঝে পাননি।

ভুক্তভোগীরা বলছেন, বেঁধে দেওয়া সময়ের মধ্যে ফ্ল্যাট বুঝিয়ে না দিয়ে ২০১৮ সালে নতুন করে ফ্ল্যাটের দাম নির্ধারণ করা হয়। নতুন দর অনুযায়ী ৮০০ বর্গফুটের জন্য ৫২ লাখ ৩৬ হাজার টাকা এবং ১০০০ বর্গফুটের জন্য ৬১ লাখ ১৬ হাজার টাকা নির্ধারণ করা হয়। তাঁরা বলছেন, স্বল্প ও মধ্যম আয়ের লোক হিসেবে দ্বিগুণ মূল্য দিয়ে এই ফ্ল্যাট নেওয়ার সামর্থ্য তাঁদের নেই। তাই তাঁরা ২০১৮ সালেই দাম বাড়ানোর প্রতিবাদে উচ্চ আদালতে রিট আবেদন করেন। এরই ধারাবাহিকতায় ২০২০ সালের ডিসেম্বর মাসে ফ্ল্যাটের বাস্তব দখল বুঝে দিতে আদালত থেকে আদেশ দেওয়া হয়। কিন্তু আদেশের ছয় মাসেও তা বাস্তবায়িত না হওয়ায় চলতি বছরের আগস্ট মাসে ভুক্তভোগীরা আদালত অবমাননার মামলা করেন। এরপর গত ২৩ নভেম্বর ফ্ল্যাটের দখল বুঝিয়ে দিতে ১৫ দিনের সময় বেঁধে দেন আদালত। কিন্তু এখনো সেই আদেশ বাস্তবায়িত হয়নি।

মানববন্ধনে মোহাম্মদপুর এফ ব্লক ফ্ল্যাট মালিক কল্যাণ সমিতির সাধারণ সম্পাদক জালাল উদ্দিন শেখ বলেন, অসহায় মানুষের আশ্রয়ের শেষ জায়গা আদালত থেকেও তাঁদের পক্ষে রায় এসেছে। এরপরও তাঁরা ফ্ল্যাট বুঝে পাচ্ছেন না। এ বিষয়ে তাঁরা প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন।

ভুক্তভোগী মোহাম্মদ আইয়ুব প্রথম আলোকে বললেন, এক টুকরা জমি পাওয়া ছিল তাঁদের কাছে স্বপ্নের মতো। এই স্বপ্ন বাস্তবায়নে জীবনের সব সঞ্চয় এখানে ব্যয় করেছেন। এখন মনে হচ্ছে, স্বপ্নের অপমৃত্যু হচ্ছে। আদালতের রায় কেন কার্যকর হচ্ছে না, তা তাঁরা বুঝতে পারছেন না। তিনি বলেন, নিরীহ মানুষেরা কোথায় যাবেন? বিচারব্যবস্থা তো প্রশ্নের সম্মুখীন হবে। এসব দেখবে কে?

জানতে চাইলে গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান দেলওয়ার হায়দার মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, এ বিষয়টি নিয়ে তাঁরা কাজ করছেন।

নতুন দরে ফ্ল্যাটের জন্য টাকা জমা দিয়ে ইতিমধ্যে সেখানে অনেকেই দখল বুঝে নিয়েছেন। ইতিমধ্যে দখল বুঝে পাওয়া ব্যক্তিদের অনেকে সেখানে বসবাসও শুরু করেছেন।