প্রতিবছর ফেব্রুয়ারি আসে বইমেলার বারতা নিয়ে। যদিও এবার একটু দেরি করে এসেছে। তাতে অবশ্য মন্দ কিছু হয়নি—এবার বসন্ত আর বইমেলা এসেছে হাত ধরাধরি করে। শাহবাগ থেকে টিএসসির পথে কোকিলের কুহু ডাক আর আমের মুকুলের ঘ্রাণ দ্রুত টেনে নিয়ে যায় টিএসসির দিকে।
খোলা আকাশের নিচে বসন্ত বাতাসে প্রাণভরে শ্বাস নিয়ে টিএসসির দিকে তাকাতেই চোখ আটকে যায় চায়ের দোকানগুলোতে। বসন্তের ছোঁয়া যেন এসে লেগেছে প্রতিটি স্টলে। কাঠের বেঞ্চ, পানি রাখার পাত্র, কেটলি— সবকিছুতেই শিল্পীর হাতের মায়াবী ছোঁয়ায় ফুটে উঠেছে নান্দনিক রিকশাচিত্র।
মেহগনিগাছের নিচে চায়ের দোকানের সামনে জন দশেক তরুণ-তরুণীর জটলা। এর মধ্য দিয়ে একজন হাঁক দিয়ে বললেন, ‘মামা ডাইরেক লিগার লাল চা।’ হাসিমুখে স্বপন মামা টুং টাং শব্দে বানাতে শুরু করলেন চা। টিএসসির এমন এক চায়ের আড্ডা থেকেই দোকানগুলোতে রিকশাচিত্র ফুটিয়ে তোলার চিন্তা আসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের ছাত্রী শিরিন শিলার মাথায়। সঙ্গে সঙ্গে তিনি বন্ধুদের জানান বিষয়টা। বন্ধুরাও রাজি হয়ে গেলেন বিনা বাক্যব্যয়ে।
২০১৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রে মিস ইউনিভার্সের মঞ্চে বাংলাদেশের লাল জামদানি আর রিকশাচিত্রের হুড পরে সবার নজর কেড়েছিলেন ঠাকুরগাঁওয়ের পীরগঞ্জের মেয়ে শিরিন শিলা। দেশি ঐতিহ্যের প্রতি তাঁর এই টান থেকেই টিএসসির চায়ের দোকানগুলোকে রিকশাচিত্রে রাঙিয়ে তোলার উদ্যোগ নেন তিনি। শিলার এই কাজে সার্বক্ষণিক সহায়তা করেন তাঁর দুই বন্ধু—চারুকলার ড্রয়িং বিভাগের সিনথিয়া সিন্থি আর পদার্থবিজ্ঞানের সীমান্ত সাহা। পুরান ঢাকার অভিজ্ঞ রিকশা আর্টিস্ট হানিফ পাপ্পু রিকশাচিত্রের পেশাদার শিল্পী। সেখানকার ছয়জন শিল্পী, শিলার কিছু বন্ধু আর কনিষ্ঠরা মিলে টানা চার দিনের নির্ঘুম রাত রংতুলির আঁচড়ে চায়ের দোকানগুলোতে ফুটিয়ে তোলেন রিকশাচিত্র। এই শিল্পকর্মের নাম দেওয়া হয় ‘দ্বিতীয় অধ্যায়: চায়ের কাপে রিকশাচিত্র’।
রিকশাচিত্র নির্মাণের উদ্যোক্তা শিলা প্রথম আলোকে বলেন, লোকসংস্কৃতির প্রতি আমার সবসময় দুর্বলতা কাজ করে। যেকোনো জায়গায় আমাদের সংস্কৃতি তুলে ধরা আমার একটি স্বপ্ন। আমি সবসময় ভাবতাম দেশি সংস্কৃতিকে ফুটিয়ে তুলব। গল্পে গল্পে শিলা বলেন, ‘মিস ইউনিভার্স বাংলাদেশে আমার যে রিকশা হুডটি ছিল, সেখান থেকেই রিকশাচিত্র কিংবা রিকশা আর্টের চিন্তা মাথায় আসে।’
‘আইডিয়াটা যখন মাথায় আসে, আর্ট কালচারের প্রতি যাঁদের দুর্বলতা আছে, তাঁরা সবাই আমাকে সাপোর্ট দিয়েছেন। অপর দিকে আর্ট কালচারের প্রতি যাঁদের ভালোবাসা নেই, তাঁদের সঙ্গে বিষয়টি শেয়ার করার পরে তাঁরা বলেছেন, কেন এটা করবে, অন্যকিছু করো।’—বলছিলেন শিরিন শিলা।
শিলা বলেন ‘আমার বন্ধুরা এই আইডিয়াটা সাপোর্ট করেছেন, সাপোর্ট করেছেন বললে ভুল হবে। তাঁরা আসলে আমার ফাঁদে পা দিয়েছেন। সিনথি আর সীমান্ত, তাঁরা আমাকে ছাড়তেও পারছেন না, আবার না–ও বলতে পারছেন না। শেষ পর্যন্ত আমাকে সঙ্গ দিতে হলো তাঁদের। আরও কয়েকজন বন্ধু আমাদের সহযোগিতা করেছেন।’
পদার্থবিজ্ঞানের মতো ভারিক্কি বিষয়ের ছাত্রী হলেও বিশ্বের নানা প্রান্তের লোকসংস্কৃতির বেশ খোঁজখবর রাখেন শিলা। তাঁর সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে বিষয়টি বোঝা গেল। শিলা বলেন, ‘আমরা ইউরোপের দেশগুলোতে যাই, সেখানকার বেকারি শপগুলো অনেক বিখ্যাত। বেকারি শপের মাধ্যমে তাঁরা নিজেদের সংস্কৃতিকে তুলে ধরে। আমাদের দেশের রাস্তাঘাট সবখানেই আছে চায়ের টং। এটাকে যদি ভালোভাবে উপস্থাপন করা যায়, তাহলে রাস্তা দিয়ে যে কেউ হেঁটে গেলেই তাঁর কাছে দেখতে সুন্দর লাগবে। নিজের সংস্কৃতিকে কেন আমরা ফুটিয়ে তুলতে পারব না। আশপাশে ভারতের জয়পুর কিংবা রাজস্থানও এটা করছে।’
জীর্ণশীর্ণ চায়ের দোকানগুলো দীর্ঘদিন ধরেই পোস্টারে মোড়ানো ছিল। প্রথম দিনে বিশ্ববিদ্যালয়ের কনিষ্ঠ অনেকে এই কাজে শিলাদের সহযোগিতা করেছেন। পোস্টারগুলো ছিঁড়ে, ধুয়েমুছে সেগুলো রং করার কাজগুলো তাঁরাই করেছেন। ভবিষ্যতে, রিকশাচিত্রের পাশাপাশি লোকশিল্পের ধরনগুলো নিয়ে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে কাজ করার পরিকল্পনার কথা জানান শিরিন শিলা।
টানা চার রাতের পরিশ্রম শেষে নান্দনিক রিকশাচিত্র নজর কেড়েছে পথচারী থেকে শুরু করে সব শ্রেণির নগরবাসীর। সবচেয়ে বেশি খুশি হয়েছেন টিএসসির চা–দোকানিরা। ইসমাইল হোসেন নামের একজন বলেন, অনেকদিন ধরে টিএসসিতে চা বিক্রি করছি। সারা বছরই এখানে বিভিন্ন ধরনের পোস্টার লাগানো হতো। সেগুলো ছিঁড়ে রং করায় দেখতে খুবই ভালো লাগছে। দূরদূরান্ত থেকে অনেকে ছবি তুলতে আসছেন এখানে। কেউ যেন পোস্টার লাগিয়ে সুন্দর চিত্রকর্ম নষ্ট না করেন সে জন্য সবাইকে অনুরোধ করেছি আমরা।
জুবায়ের আহমেদ নামের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষের এক শিক্ষার্থী বলেন, এর আগে টিএসসিতে কোনো চিত্রকর্ম ছিল না। ক্যাম্পাসের নতুন শিক্ষার্থীরা নতুন এই সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচত হচ্ছেন। এই জিনিসগুলো তাঁদের আকর্ষণ করছে। এ ধরনের আর্টগুলো আমরা রিকশার পেছনে কিংবা দেয়ালে দেখতাম। কিন্তু সেগুলো চায়ের দোকানে দেখে আরও ভালো লাগছে।
সাবিহা নূর নামের আরেক শিক্ষার্থী বলেন, টিএসসিতে বসে চা খাওয়ার আনন্দই আলাদা। আরও মন ভালো হয়েছে যখন দেখলাম টিএসসিতে এ ধরনের চিত্র করা হয়েছে। এটা দেখে খুবই ভালো লাগছে। রং তো সবসময়ই ভালো লাগে, আর ফেব্রুয়ারি মাস এলে মন তো আরও ভালো হয়ে যায়। সকালে এসে এই রং দেখে সবকিছুর সংমিশ্রণে সকালটা আরও প্রাণবন্ত হয়ে গেছে।
ক্যাম্পাসের দেয়ালগুলোতেও নান্দনিক চিত্র ফুটিয়ে তোলার দাবি জানান বাংলা বিভাগের স্নাতকোত্তর পর্যায়ের ছাত্রী তাসলিমা আক্তার।
এই কাজে শিক্ষার্থীদের সহযোগিতা করেছেন পুরান ঢাকার হোসেনি দালান এলাকার হানিফ পাপ্পু । তাঁর প্রতিষ্ঠানটি প্রায় ৫৫ বছর ধরে বাণিজ্যিকভাবে রিকশাচিত্র নিয়ে কাজ করে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, শিক্ষার্থীদের সঙ্গে এই ধরনের কাজ করতে পেরে খুবই ভালো লাগছে। টিএসসিতে রিকশাচিত্র আঁকায় সেখানকার সৌন্দর্য বেড়েছে। এখন আর মানুষ জায়াগাটি নোংরা করতে চাইবেন না।
হানিফ পাপ্পু বলেন, ‘স্টুডেন্টরা কিছু ধারণা দিয়েছে। আমরাও নিজেদের অভিজ্ঞতা দিয়ে পুরো কাজটি করেছি। তাঁদের উৎসাহেই আমরা এ কাজ করেছি। এতগুলো দোকানে একসঙ্গে রিকশাচিত্র দেখে মানুষের ভালো লাগবে।’
তিনি আরও বলেন, রিকশাচিত্র আঁকার পরে মানুষের কাছ থেকে ভালো সাড়া পাচ্ছি। এর মাধ্যমে হারিয়ে যাওয়া রিকশাচিত্রের ঐতিহ্য আবার ফিরে আসবে, শিল্পীরাও ভালো থাকবে বলে মনে করেন তিনি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের প্রাচ্যকলা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মলয় কুমার বালা প্রথম আলোকে বলেন, শৈল্পিক জায়গা থেকে শিক্ষার্থীরা রিকশাচিত্র করেছেন। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এ ধরনের চিত্র করা হয়। টিএসসির চায়ের দোকানে নান্দনিক কাজের মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা নিজেদের সংস্কৃতিকে তুলে এনেছেন। এটা একটি পপুলার আর্ট।
মলয় কুমার বালা আরও বলেন, ‘এই কাজে রিকশার রং লেপন ঠিক হয়েছে কি না, সেটা মুখ্য নয়। মূল বিষয় হলো, নন্দনবোধ তৈরি করা। মূলত এখানে তাঁদের উদ্যোগটাই প্রধান। তাঁদের এই উদ্যোগকে আমরা অনেকেই হয়তো অন্যভাবে দেখি।
কিন্তু ফল ভোগের সময় আমরা সবাই সেটা উপভোগ করি। গত ২০ থেকে ৩০ বছরে টিএসসিতে এমন নান্দনিক কাজ দেখা যায়নি।’
চারুকলার ওই শিক্ষক বলেন, রিকশার পেছনের আর্ট হয়তো সবার চোখে পড়ে না। কিন্তু, এতগুলো টি–স্টলে সেটা থাকায় সবার চোখে পড়বে, সবাই চিন্তা করবেন এটা নিয়ে। এ ধরনের কাজের ফলাফল সূদুরপ্রসারী। এটা সমাজের মানুষকে ভালো কাজ করতে উদ্বুদ্ধ করবে।