বেসরকারি একটি এয়ারলাইনসের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেখে কেবিন ক্রু পদে চাকরির জন্য আবেদন করেছেন মেঘা শর্মা। ট্রান্সজেন্ডার পরিচয়েই কেবিন ক্রু হতে চান তিনি। তবে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে জেন্ডারের ঘরে নারী ও পুরুষ ছাড়া অন্য কোনো ঘর না থাকায় বিপত্তি ঘটে। প্রথমে ভেবেছিলেন আবেদনই করবেন না, পরে অন্যরা নারী হিসেবে আবেদন করার পরামর্শ দিলে আবেদন করেন মেঘা।
গতকাল রোববার প্রথম আলোকে মেঘা বলেন, ‘বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী শিক্ষাগত যোগ্যতা, উচ্চতাসহ সব যোগ্যতাই আমার আছে। আমি চেয়েছিলাম ট্রান্সজেন্ডার হিসেবেই এ পদে আবেদন করার জন্য। কিন্তু এর তো আর উপায় নেই। আমি আবেদন করেছি মেঘা শর্মা হিসেবে। কিন্তু আমার শিক্ষাগত সনদে তো আমি সুবল শীল।’ গত শনিবার ওই পদে আবেদন করেন মেঘা।
মেঘা বলেন, তাঁর কাস্টমার কেয়ারে কাজ করার অভিজ্ঞতা আছে। এখন বেসরকারি একটি সংস্থায় কাজ করছেন তা–ও কাস্টমার কেয়ারসংক্রান্ত। তাই আবেদনে টিকে গেলে তিনি এয়ারলাইনস কর্তৃপক্ষকে বিষয়টি বুঝিয়ে বলতে পারবেন। তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস, তাঁকে সুযোগ দেওয়া হলে যাত্রীরাও তাঁকে খুব সহজেই মেনে নেবেন। ট্রান্সজেন্ডারের বিষয়টি জানানোর জন্য আবেদনের আগে এয়ারলাইনসটির মেসেঞ্জারে তিনি এ বিষয়ে কথাও বলতে চেয়েছিলেন, তবে কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে আর কোনো উত্তর পাওয়া যায়নি।
কেবিন ক্রু হিসেবে চাকরিটি কেন পছন্দ, এ প্রশ্নের উত্তরে ২৩ বছরের মেঘা বলেন, এ পেশায় সাজিয়ে গুছিয়ে নিজেকে উপস্থাপন করা যায়। এ ছাড়া মানুষের সেবা করারও সুযোগ পাওয়া যায় এ পেশায়। এ ছাড়া দেশে তাঁর জানামতে, কোনো ট্রান্সজেন্ডার এখন পর্যন্ত এ পেশায় নিয়োগ পাননি। সব মিলিয়েই এ পেশার প্রতি তাঁর আগ্রহ।
মেঘা জানালেন, তিনি কেবিন ক্রু হতে চান, এ ইচ্ছার কথা গণমাধ্যমে আগেও জানিয়েছিলেন। রাজধানীর ফার্মগেটের বেসরকারি একটি সংস্থা তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করে। পরে সংস্থাটির পক্ষ থেকে মেঘা কেবিন ক্রুর জন্য চার মাসের একটি কোর্স সম্পূর্ণ বিনা মূল্যে করার সুযোগ পেয়েছেন। তাই এ পেশার জন্য কিছুটা প্রশিক্ষণও হয়েছে।
ঠাকুরগাঁওয়ে মেঘার জন্ম হয়েছিল। ছেলেশিশু হিসেবেই পরিচিত ছিল। তবে যখন থেকে মেঘা বুঝতে শিখেছেন, তখন থেকেই তিনি নিজেকে নিয়ে ভাবতেন। কেননা, অন্য ছেলেশিশুরা যে আচরণ করে, তা তিনি করতে পছন্দ করতেন না। মায়ের শাড়ি পরতে ভালো লাগত। সাজতে ভালো লাগত। এ নিয়ে মায়ের কাছে পিটুনিও খেতে হয়েছে। বাইরে অন্যদের হাতে মার খেয়ে কান্নাকাটি করতে করতে বাড়ি ফিরলে তখন আবার মা মারতেন, কেন তিনি অন্য ছেলেদের মতো বাইরে মারামারি করতে পারেন না সে জন্য।
মেঘা বলেন, ‘সিংহ পুরুষ হতে চাইনি কখনোই। সব সময় নিজেকে মেয়ে ভাবতেই ভালো লাগত। আগে থেকেই আমার আচরণ ও সাজসজ্জায় তা প্রকাশ পেত। গত বছর অস্ত্রোপচার করে পুরুষ থেকে নারীর পরিচয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে চলাফেরা শুরু করি। ফেব্রুয়ারি মাসের শুরুতে মেয়ে পরিচয়েই ঢাকা থেকে বাড়ি যাই। পরিবারের সদস্যদের বিষয়টি বোঝাতে বেশ সময় লেগেছে। তবে আমার পরিবার বিষয়টি ভালোভাবেই মেনে নিয়েছে। মা–বাবা আমাকে ছেলে বা মেয়ে না ভেবে সন্তান হিসেবে ভেবেই সব মেনে নিয়েছেন। বাড়িতে আমাকে দেখতে ভিড় লেগে গিয়েছিল। বিভিন্ন গণমাধ্যমে আমাকে নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশিত হলে আগে যারা খারাপ ব্যবহার করেছিল, তারাও আমার পাশে আছে বলা শুরু করেছে। তবে আমি তো আমার সেই দিনগুলোর কথা ভুলে যাইনি।’
ছোটবেলার যন্ত্রণার দিনগুলোর কথা মনে রাখতে চান না মেঘা। জানালেন, পরিবারের পাশাপাশি তিনি তাঁর কর্মস্থল এবং কবি নজরুল সরকারি কলেজের শিক্ষক এবং বন্ধুদের কাছ থেকে ইতিবাচক ব্যবহার পেয়েছেন। ফলে তাঁর সংগ্রামটা অনেকটাই সহজ হয়ে গেছে।
তবে একেবারে সংগ্রাম থেমে গেছে, তা–ও তো বলার উপায় নেই। কবি নজরুল সরকারি কলেজে অনার্স তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী মেঘা বললেন, নারী পরিচয়ে বাড়ি ফেরার পর অনেকেই তাঁর বাবা নরসুন্দর জগেশ শীলকে নানাভাবে ভয়ভীতি দেখিয়েছেন।
মেঘা বললেন, ‘পড়াশোনা করছি। ২০১৯ সাল থেকেই চাকরি করছি। ট্রান্সজেন্ডারদের নিয়ে সমাজে কিছুটা ইতিবাচক পরিবর্তনও এসেছে। তারপরও সেদিন এক দোকানে গেলে আমাকে ১০ টাকা ধরিয়ে দেয়, ভেবেছে আমি টাকা তুলতে গিয়েছি। বাসের সহকারীও কুৎসিত মন্তব্য করতে ছাড়ে না। অনেকে ভেবেই নেয়, ট্রান্সজেন্ডার মানেই তার সঙ্গে খুব সহজে যৌনকাজ করা যাবে। বাড়ি ভাড়া পেতে ভোগান্তির অন্ত নেই। শিক্ষাগত সনদ পরিবর্তন করতে গেলে কত ধরনের হয়রানির মুখে পড়তে হবে, তা ভেবে আগেই ভয় পাচ্ছি।’
ভুল শরীরে জন্ম হয়েছে, এ চিন্তা তাড়িয়ে বেড়াত মেঘাকে। মেঘা জানান, তিনি আসলে কে, তা বের করতে বা বুঝতেই অনেক সময় চলে গেছে। আগে ছিলেন দুই ভাই এক বোন। এখন মেঘা বলেন, তাঁরা দুই বোন আর এক ভাই। ভাই বোনদের মধ্যে তিনি বড়। অস্ত্রোপচারের পর শারীরিক কিছু জটিলতা পোহাতে হচ্ছে মেঘাকে। মেঘার জীবনের সব তথ্য জেনে যদি কেউ তাঁকে বিয়ে করতে চান, তাতে আপত্তি নেই মেঘার। সন্তানের মা হতে পারবেন কি না, তা জানা নেই মেঘার। তবে মেঘা মনে করেন নারী বা রূপান্তরিত নারী পরিচয়ে পরিচিত হওয়ার তো আরও অনেক পথ আছে।
মেঘা বললেন, ‘আমি ট্রান্সজেন্ডার পরিচয়েই কেবিন ক্রু হতে চাই। আর এটা হতে পারলে তা–ও তো সমাজে অনেকটুকু পরিবর্তন বয়ে আনবে। একটি এয়ারলাইনস এ ধরনের সিদ্ধান্ত নিতে পারলে অন্যরাও উৎসাহী হবে।’