ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিলে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিল করার জন্য সবাইকে একসঙ্গে সোচ্চার হতে হবে। এই আইনের অপব্যবহারের মাধ্যমে স্বাধীন সাংবাদিকতা ও জনসাধারণের বাক্স্বাধীনতাকে রুদ্ধ করা হচ্ছে। জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে এ আইনের অপব্যবহার আরও বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে। আজ শনিবার সকালে গবেষণাপ্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজ (সিজিএস) আয়োজিত এক অনলাইন আলোচনা সভায় এসব কথা বলেন বক্তারা। স্বাধীনভাবে সংবাদ প্রকাশ ও কার্টুনচিত্র করার অধিকার হরণের কথা তুলে ধরে বক্তারা প্রথম আলো ও এর বিশেষ প্রতিনিধি রোজিনা ইসলাম, কারাগারে মারা যাওয়া লেখক মুশতাক আহমেদ, কার্টুনিস্ট আহমেদ কবির কিশোর ও ফটোসাংবাদিক শফিকুল ইসলাম কাজলের কারাবন্দিত্বের প্রসঙ্গ টানেন।
‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ২০১৮: নাগরিক সমাজের চোখে’ শিরোনামে আয়োজিত সভায় বলা হয়, আইনটি সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। আইনটির সংজ্ঞায় অস্পষ্টতা থাকার কারণে মানবাধিকারকর্মী, শিক্ষার্থী, সুশীল সমাজ ও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ব্যাপক সমালোচনা থাকার পরও সরকার ২০১৮ সালে আইনটি প্রণয়ন করে। এ আইনের আওতায় যেকোনো যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড ঘটানোর সন্দেহে পরোয়ানা ছাড়াই আইন প্রয়োগকারী সংস্থা নাগরিকদের গ্রেপ্তার করার ক্ষমতা পেয়েছে। দিন দিন এ আইনের আওতায় করা মামলার সংখ্যা বাড়ছে। বিভিন্ন গণমাধ্যম থেকে পাওয়া তথ্য অনুসারে ২০২০ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ২০২১ সালের মার্চ মাস পর্যন্ত দেড় হাজারের বেশি মামলা হয়েছে। ২০১৮ সালে ৯২৫টি, ২০১৯ সালে ১ হাজার ১৮৯টি এবং ২০২০ সালে ১ হাজার ১২৮টি মামলা হয়েছে।
আলোচনায় অংশ নিয়ে সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনটি জনগণের স্বার্থে নয়, শাসকদের স্বার্থে করা হয়েছে। আইনে ফাঁকফোকর রাখা হয়েছে অপব্যবহার করার জন্য। আইনটি বাতিলে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে আন্দোলন না করলে প্রতিকার পাওয়া যাবে না। সামনে জাতীয় নির্বাচনকে ঘিরে এই আইনের মাধ্যমে রাজনীতিতে উত্তেজনা সৃষ্টি হবে এবং অপপ্রয়োগ বাড়বে বলে আশঙ্কা করা যাচ্ছে।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সাবেক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আবদুল মজিদ বলেন, আইনের দোষ নয়, দোষ আইন প্রয়োগকারীদের দৃষ্টিভঙ্গির। আইনটির নানাভাবে অপপ্রয়োগ করা হচ্ছে। আলোচনার ভিত্তিতে আইনটি সংশোধন করা প্রয়োজন।
রাষ্ট্রদ্রোহ, ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত ও মানহানি—এই তিনটির মতো অস্পষ্ট বিষয়ে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অপব্যবহার বেশি হচ্ছে বলে উল্লেখ করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কেটিং বিভাগের অধ্যাপক মীজানুর রহমান। তিনি বলেন, সরকারের ব্যক্তিদের সুরে কথা না বললে ‘রাষ্ট্রদ্রোহ’ বলা হচ্ছে। উচ্চ স্তরে থাকা ওই ব্যক্তিদের এ ধরনের প্রবণতা নিচের দিকে আইন প্রয়োগকারী ব্যক্তিরাও রপ্ত করছেন।
আলোচনায় অংশ নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী তানিয়া আমীর বলেন, বিতর্কিত বিশেষ ক্ষমতা আইনের মতো একইভাবে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অপব্যবহার হচ্ছে। মামলার ভয়ে সবকিছুতে এখন আত্মনিয়ন্ত্রণ চলছে। সাংবাদিকেরা আত্মনিয়ন্ত্রণে চলে যাচ্ছেন। সাংবাদিকেরা দায়িত্ব পালনে, পেশাদারত্ব রক্ষায় ব্যর্থ হলেন কি না, আইনটি কার স্বার্থে ব্যবহার হচ্ছে, সে প্রশ্ন থেকে যায়। তিনি আরও বলেন, ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের মাধ্যমে বিশেষ ক্ষমতা আইনকে বাতিল করা গিয়েছিল। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিলেও একইভাবে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে।
আর্টিকেল নাইনটিন–এর বাংলাদেশ ও দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক পরিচালক ফারুখ ফয়সল বলেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মতো আরও কিছু আইন স্বাধীন মতপ্রকাশের অধিকার হরণ করছে। ব্রিটিশ আমলের আইন অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট এ পর্যন্ত দুজন সাংবাদিকের ওপর অপব্যবহার করা হয়েছে। সর্বশেষ প্রথম আলোর সাংবাদিক রোজিনা ইসলামের ক্ষেত্রেও তাই ঘটেছে। এরপর আন্তর্জাতিক পুরস্কার জিতেছেন রোজিনা ইসলাম। সীমান্তের বাইরে থেকে এক সাংবাদিক সরকারের সমালোচনা করায় তাঁর বোনকে ধরে আনা হয়েছে, যা আইনসংগত নয়। এসব আইন নাগরিকের অধিকার ও গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে যে অপব্যবহার হচ্ছে, তা আন্তর্জাতিক মহল প্রত্যক্ষ করছে।
আলোচনা সভার সভাপতিত্ব করেন সিজিএসের চেয়ারম্যান মনজুর আহমেদ চৌধুরী। তিনি ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিলে আইনজীবীদের ঐক্যবদ্ধ হয়ে রিট করার আহ্বান জানান। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন সিজিএসের নির্বাহী পরিচালক জিল্লুর রহমান।