ডেঙ্গুতে মারা গেল চার মাসের শিশু

আহমাদ

ঢাকা শিশু হাসপাতালের ওয়ার্ড থেকে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ)। সেখান থেকে লাইফ সাপোর্টে। তারপরও ডেঙ্গুর সঙ্গে পেরে ওঠেনি চার মাস বয়সী শিশুটি। ব্যর্থ হয়েছেন চিকিৎসকেরাও। ফলে হাসপাতাল থেকে বাসা নয়, যেতে হলো পরপারে। শনিবার দিবাগত রাত সোয়া তিনটার দিকে শিশু আহমাদ মারা যায়।

৩ মাস ২৭ দিন বয়সী আহমাদের জীবনের শেষের ১৩ দিনই কেটেছে হাসপাতালে। গত ২৭ এপ্রিল জন্ম হয় আহমাদের। তারা থাকত কল্যাণপুরে।

আহমাদের বাবা নাসির উদ্দিন একটি মাদ্রাসার শিক্ষক। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ঈদের আগে প্রথমে জ্বর আসে তাঁর। এরপর জ্বর আসে বড় সন্তান ও শ্যালকের। কিন্তু সবার জ্বরই ভালো হয়ে যায়। এ মাসের ৫ তারিখ ভোরে জ্বর আসে শিশু আহমাদের। নাপা ড্রপস খাওয়ানোর পরই শিশুটির জ্বর সেরে যায়।

নাসির উদ্দিন বলেন, ‘পরে আমার বাচ্চাটার শরীর বেশ ঠান্ডা ও দুর্বল হয়ে গেছে। কিন্তু আগে আমাদের জ্বর ভালো হয়ে যাওয়ায় (বাচ্চার) দুর্বলতাকে স্বাভাবিক অসুখ হিসেবেই নিয়েছিলাম।’

এরপর দুই দিন ভালো থাকার পর রাতে খিঁচুনি হয় শিশু আহমাদের। নাসির উদ্দিন বলেন, ‘আমি এই খিঁচুনির সঙ্গে আগে পরিচিত ছিলাম না। ফলে বুঝতে পারিনি যে খিঁচুনি। ভোররাতে আবার খিঁচুনি হয়।’

৯ আগস্ট আহমাদকে ঢাকা শিশু হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। কিছুদিন ওয়ার্ডে থাকার পর নেওয়া হয় আইসিইউতে।

নাসির উদ্দিন বলেন, ‘আইসিইউর প্রথম দুই দিনে খিঁচুনি, শ্বাসকষ্ট কমে গিয়েছিল। আমরা আশান্বিত ছিলাম। হঠাৎ করে ক্যানুলাটা সরানো হয়েছে। পরে আবার আরেকটা পরানো হয়েছে। এরপর থেকেই ওর শরীরটা আবার খারাপ হতে শুরু করে, জ্বর ও খিঁচুনি আসে। (অবস্থার) আর উন্নতি হয়নি, খারাপের দিকে চলে যাচ্ছিল।’

আশঙ্কাজনক অবস্থায় ১৯ তারিখ তাকে লাইফ সাপোর্টে নেওয়া হয়।
‘শনিবার দিবাগত রাত ৩টা ১১ মিনিটে হাসপাতাল থেকে ফোন দিয়ে বলে, সকালে চলে আসেন। বলল, বাচ্চা দেখে যান দেখতে চাইলে। ওর অবস্থা ভালো না।’—বলেন নাসির উদ্দিন। সকালে তাঁর শ্বশুর হাসপাতালে গিয়ে জানতে পারেন মধ্যরাত ৩টার দিকেই শিশুটি মারা গেছে।

দীর্ঘশ্বাস নিয়ে নাসির উদ্দিন বলেন, ‘হাসপাতাল থেকে রক্ত, প্লাটিলেট চাইছে। এগুলো দিয়েছি। কিন্তু বাঁচানো গেল না।’

শিশুটির চিকিৎসা করেছেন হাসপাতালটির ক্রিটিক্যাল কেয়ার পেডিয়াট্রিকস বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মাদ মনির হোসেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, এবারকার ডেঙ্গু গতবারের চেয়ে ভিন্ন। গতবারের লক্ষণ ছিল প্রথমে জ্বর আসে। জ্বর থাকার পর শিরা–উপশিরা ছিদ্র হয়ে প্লাজমাগুলো বেরিয়ে যেত। একপর্যায়ে তারা শকে চলে যায়। কিন্তু এবার আগের সমস্যার পাশাপাশি রোগীরা হৃৎপিণ্ডে ও মস্তিষ্কে সমস্যা নিয়ে আসছে। একে বলে এক্সপান্ডেড ডেঙ্গু সিনড্রোম। ফলে ছয় মাসের নিচে বাচ্চাদের ডেঙ্গুতে ঝুঁকি বেশি, বিশেষ করে মৃত্যুঝুঁকি।

অধ্যাপক মোহাম্মাদ মনির হোসেন আরও বলেন, ‘এই বাচ্চাটি খিঁচুনি ও জ্বর নিয়ে এসেছে। এমনটা হলে আমরা মনে করি যে মস্তিষ্কের সমস্যা। সাত দিন পরে আইজিএম পরীক্ষাটা করে দেখলাম ডেঙ্গু পজিটিভ। তারপর পেশেন্ট খারাপ হয়ে যায়। এরপর ভেন্টিলেটর দিতে হলো।’ তিনি আরও বলেন, আহমাদের ওজন বয়সের তুলনায় একটু বেশি থাকায় সমস্যাটা বেশি হয়েছে। ডেঙ্গু হলে প্রতিরোধক্ষমতা কমে যায়। ফলে নিউমোনিয়া, সেপটিসেমিয়া (রক্তের সংক্রমণ) সংক্রমণের মাত্রাটা বেশি। এই বাচ্চাটিরও এসব সমস্যা ছিল। তার ওপর বয়সও ছিল ছয় মাসের কম।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগনিয়ন্ত্রণ শাখার সর্বশেষ মশা জরিপ অনুসারে, ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের ১০০টি এলাকার মধ্যে ৫৬টিতেই ডেঙ্গু জ্বরের বাহক এডিস মশার লার্ভা পাওয়া গেছে। এর মধ্যে দক্ষিণ সিটির বাসাবো, গোড়ান ও এলিফ্যান্ট রোডে সবচেয়ে বেশি মশার ঘনত্ব পাওয়া গেছে।

আর উত্তর সিটির মগবাজার, বসুন্ধরা ও কল্যাণপুর এলাকা সবচেয়ে বেশি ডেঙ্গু সংক্রমণের ঝুঁকিতে রয়েছে। ডেঙ্গুতে মারা যাওয়া আহমাদও ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয় কল্যাণপুরে।

গতকাল পর্যন্ত এ বছর দেশে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে মোট ৩৬ জন। এর মধ্যে সংখ্যাটা ঢাকা মহানগরে সবচেয়ে বেশি, ৩২ জন। এর বাইরে চট্টগ্রাম বিভাগে ২ জন, খুলনায় ১ জন, রাজশাহীতে ১ জন। আর ঢাকার হাসপাতালগুলোর মধ্যে মিটফোর্ড হাসপাতালে মারা গেছে ৪ জন ও ঢাকা শিশু হাসপাতালে ৭ জন।

ঢাকা শিশু হাসপাতালের এপিডেমিওলজিস্ট (রোগতত্ত্ববিদ) কিংকর ঘোষ বলেন, হাসপাতালটিতে গত চার বছরে যত শিশুর মৃত্যু হয়েছে, তার মধ্যে আহমাদ সর্বকনিষ্ঠ।