ডেঙ্গু-কোভিড রোগীর চাপ সামাল দিতে হিমশিম

ডেঙ্গু ও করোনায় আক্রান্ত শিশুদের চিকিৎসা দিতে হিমশিম খাচ্ছে ঢাকা শিশু হাসপাতাল।
ছবি: প্রথম আলো

সাত মাস বয়সী মিনার শ্বাসকষ্ট হচ্ছিল খুব। নানা শাহজাহান মিয়ার কোলে চড়ে গত শুক্রবার ঢাকা শিশু হাসপাতালে এসেছিল সে। হাসপাতালে জায়গা হয়নি। ছোট্ট প্রাণটুকুও বাঁচানো যায়নি আর।

বাড্ডার বাসিন্দা শাহজাহান মিয়া রোববার প্রথম আলোকে বলেন, পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর ভালো চিকিৎসার জন্য নাতনিকে ঢাকা শিশু হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন চিকিৎসক। চিকিৎসকের পরামর্শে সেখানে নিয়েও গিয়েছিলেন তাঁরা। শিশুটিকে দেখে চিকিৎসকেরা বলেন, বাচ্চাকে আইসিইউতে দিতে হবে। কিন্তু শিশু হাসপাতালে আইসিইউ খালি নেই। অন্য হাসপাতালে নিতে হবে। শিশু হাসপাতাল থেকে অন্য হাসপাতালে যাওয়ার পথে গাড়িতেই মিনা মারা যায়।

মিনার মতো অনেক রোগীকে জায়গা দিতে পারছে না ঢাকা শিশু হাসপাতাল। হাসপাতালের উপপরিচালক প্রবীর কুমার সরকার রোববার প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি বলব, এমন সংকটময় পরিস্থিতি চিকিৎসকেরা পার করেছেন কি না, বলতে পারছি না। যদি একটা তুলনা করি, আমরা ৬০০ কোভিড-১৯ রোগীকে চিকিৎসা দিয়েছি। আজকের খবর হলো কোভিডের ২০টি শয্যার একটাও খালি নেই। এটা হলো ঘটনার শুরু। রোগীকে হয়তো ঢাকা মেডিকেলে পাঠাতে হচ্ছে। সেখানেও করোনায় আক্রান্ত শিশুদের জন্য ২০-২৫টি আসন। দেখা যাবে, সেখানেও সে ভর্তি হতে পারছে না। তাহলে এসব রোগীর ভাগ্যে কী ঘটবে?’

টঙ্গী থেকে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত শিশু মারিয়াকে চিকিৎসার জন্য নিয়ে আসেন তার অভিভাবকেরা।
ছবি: প্রথম আলো

এই চিকিৎসক আরও বলেন, সারা বছরে ডেঙ্গুর যত রোগী ছিল, গত দুই মাসে সেই সংখ্যা তিন গুণের বেশি হয়েছে। রোববার ছিল ৫০ জন রোগী। এর মধ্যে অধিকাংশ সংকটজনক অবস্থায় আসা। দেখা যাচ্ছে কমপক্ষে ৬০ শতাংশ শিশু ‘শক’ নিয়ে। এদের কারও কারও রক্তক্ষরণ হয়, রক্তনালি থেকে পানি বেরিয়ে যায়। এতে রোগীর শরীরের রক্তের যে উপাদান সেগুলো থাকে। কিন্তু দেহের ভেতর রক্ত পরিবহন ব্যবস্থা বাধা পায়। এ ধরনের রোগীর জন্য বিশেষ ব্যবস্থাপনা দরকার। সেটা নিশ্চিত করা না গেলে অনেক সময় শিশুদের হারাতে হয়। তাদের লিভার, কিডনি, মস্তিষ্ক সবই একে একে অকেজো হয়ে পড়ে।

ঢাকা শিশু হাসপাতাল সংকটাপন্ন রোগীদের কতটা চিকিৎসা দিতে পারছে? এ বিষয়ে চিকিৎসকেরা বলেন, যে পরিবেশে এ ধরনের রোগীর চিকিৎসা হওয়া দরকার, ওয়ার্ড বা কেবিনে সেটা সম্ভব না। হাসপাতালে ৩০-৪০টি শিশুর জন্য চারজন নার্স আছেন। ৮-১০ জন রোগীর জন্য একজন ডাক্তার। অথচ এমন একজন রোগীর জন্য সার্বক্ষণিক একজন নার্স, দু-তিনজনের জন্য একজন চিকিৎসক থাকা দরকার।

কোভিড শুরুর পর থেকে প্রতি মাসে ৫-৭ জন চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মী কোভিডে আক্রান্ত হচ্ছেন। তাঁদের ১৪ দিনের জন্য কাজের বাইরে থাকতে হচ্ছে। নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রেও (আইসিইউ) যথেষ্ট শয্যার ব্যবস্থা করা যাচ্ছে না। ঢাকা শিশু হাসপাতালে পেডিয়াট্রিক, নরমাল, নিওন্যাট, কার্ডিয়াক আইসিইউতে নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা দিয়ে ও বিনা মূল্যে ৪৭ শয্যায় রোগী রাখার ব্যবস্থা আছে। রোববার শুধু কার্ডিয়াক আইসিইউর ছয়টি শয্যার মধ্যে দুটি কেবল ফাঁকা ছিল। তার একটি থেকে অভিভাবকেরা আবার নিজ দায়িত্বে শিশুকে নিয়ে চলে যাওয়ায় ফাঁকা হয়েছে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মোট ৬৭৩ শয্যার হাসপাতালের বেশির ভাগই পূর্ণ। ফলে দূর-দূরান্ত থেকে অসুস্থ শিশু কোলে বাবা-মায়েরা আসছেন, শয্যা ফাঁকা না পেয়ে ফিরে যাচ্ছেন। রোববারও ডেঙ্গু আক্রান্ত ৫০ জন রোগী ভর্তি ছিল ঢাকা শিশু হাসপাতালে। তার মধ্যে আটজন ছিল নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে। এখন পর্যন্ত ১৯৯ জন এই হাসপাতালে ডেঙ্গুর চিকিৎসা নিয়েছে, ৪ জন মারা গেছে। ৮ জন আইসিইউতে।

ডেঙ্গু ওয়ার্ডের একটি বিছানাও রোববার ফাঁকা পাওয়া যায়নি। সার বেঁধে মশারি টাঙিয়ে শিশুদের নিয়ে বসে থাকতে দেখা গেছে অভিভাবকদের। ঠিক কী পরিস্থিতিতে ১০ বছরের নাতি রবিউলকে নিয়ে এসেছেন জানতে কথা হয় আনসার আলীর সঙ্গে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ওয়ারী থেকে তিনি যখন নাতিকে নিয়ে আসেন, তখন তার গায়ে প্রচণ্ড জ্বর। বমির সঙ্গে রক্ত পড়ছে। কিছুতেই জ্বর কমছে না দেখে ঢাকা শিশু হাসপাতালে নিয়ে আসেন। পাঁচ দিন পর নাতি উঠে বসেছে। এই শয্যার পাশেই আড়াই বছরের নাতিকে নিয়ে বসে ছিলেন রোকেয়া আক্তার। নাতির হাতে ক্যানুলা। চিৎকার করে কাঁদছে। উপসর্গ একই। জ্বর নামছে না। উল্টো পাশে ঘুমন্ত তিন বছরের শিশুটি চিকিৎসায় কিছুটা সেরে উঠেছে।

ডেঙ্গু ছাড়াও কোভিড ইউনিট প্রায় প্রতিদিনের মতো ভর্তি ছিল। এই শিশুদের জন্য আলাদা কোনো নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র নেই। টঙ্গী থেকে নাকে অক্সিজেনের নল লাগিয়ে অস্বস্তি নিয়ে বসে ছিল শিশু মারিয়া। মারিয়ার মা নাশারাত জাহান বলছিলেন, মেয়ের নিউমোনিয়া হয়ে গেছে। ভালোই ছিল। হঠাৎ নিউমোনিয়া। কেন এমন বুঝতে পারছেন না তিনি। চিকিৎসকদের পরামর্শে এসেছেন ঢাকা শিশু হাসপাতালে। পাশেই মায়ের কোলে শোয়া কয়েক মাসের শিশুর গা জ্বরে পুড়ছে। সেও অপেক্ষায় একটা শয্যার।

বহির্বিভাগেও অসংখ্য রোগী। প্রতিবন্ধিতা, কিডনি জটিলতা, হৃদরোগসহ নানা রোগে ভোগা শিশুরা বরাবরের মতোই চিকিৎসা নিতে এসেছে শিশু হাসপাতালে। বহির্বিভাগে অ্যাজমায় ভোগা শিশুদেরও ভিড় দেখা গেল।

ঢাকায় শিশুদের জন্য বিশেষায়িত হাসপাতাল বলতে এই ঢাকা শিশু হাসপাতাল। রেকর্ডরুমে কর্মরত ব্যক্তির কাছে কতগুলো আসন ফাঁকা জানতে চাইলে বলেন, ১৬৫টি শয্যা ফাঁকা। তবু ঠাঁই নেই কেন? এমন প্রশ্নে তিনি জানান, একেক রোগের জন্য একেক ওয়ার্ড, শয্যাও আলাদা। কোনো ওয়ার্ডে দুটি, কোনোটিতে তিনটি এমন করে ফাঁকা আছে। এই শয্যাও ভরে যাবে দিনের মধ্যেই।