করোনা সংক্রমণ
মাস্কের বাজারেও ‘দ্বিতীয় ঢেউ’
বাবুবাজারের পাইকারি দোকানে সার্জিক্যাল মাস্ক প্রতিটি ১ থেকে ৩ টাকায় বিক্রি হয়। খুচরায় ৫ থেকে ৭ টাকা।
আমদানি কমছে, দেশেই বেশি তৈরি হচ্ছে।
নিম্নমান ও নকল মাস্ক বিক্রি করার বিস্তর অভিযোগ।
ঢাকার বাবুবাজার থেকে পাইকারি দরে মাস্ক কিনে নিয়ে নারায়ণগঞ্জের দোকানে দোকানে বিক্রি করেন পাইকারি ব্যবসায়ী সাদুল মতিন। গতকাল বুধবারও তিনি গিয়েছিলেন বাবুবাজার। ঘণ্টাখানেক ঘুরে ৫ হাজার সার্জিক্যাল মাস্ক কেনেন ১০ হাজার ১০০ টাকায়।
বেলা তিনটার দিকে মাস্ক কেনা শেষে সাদুল মতিন প্রথম আলোকে জানান, দুই সপ্তাহ আগেও ১১ হাজার টাকায় তিনি ১০ হাজার মাস্ক কিনেছিলেন। এখন দাম প্রায় দ্বিগুণ। তিনি বলেন, দুই সপ্তাহ ধরে প্রায় প্রতিদিনই মাস্কের দাম বাড়ছে।
বাবুবাজারে দ্বিতীয় বুড়িগঙ্গা সেতুর নিচে মাস্কের পাইকারি বাজার বসে। ঢাকাসহ দেশের জেলায় জেলায় যে মাস্ক সরবরাহ হয়, তার বড় অংশ যায় বাবুবাজার থেকে। সেখানে দাম বাড়ার প্রভাব পড়েছে ঢাকার খুচরা দোকানেও। খিলগাঁও চৌরাস্তার জনতা ফার্মেসির দোকানি মো. মাসুদ জানান, তাঁর দোকানে ৫০টির এক প্যাকেট সার্জিক্যাল মাস্ক গতকাল দেড় শ টাকার মতো দামে বিক্রি হয়। এক সপ্তাহ আগেও তা ২০ টাকা কম ছিল।
নতুন করে শনাক্তের সংখ্যা বাড়ার পর বাজারে মাস্কের চাহিদা ও দাম বাড়ছে। দেশেই বেশি উৎপাদন। রপ্তানিও হচ্ছে।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, মাস্কের চাহিদা ও দাম বাড়ার প্রবণতা আসলে দ্বিতীয় ঢেউ। বাজারে গত কয়েক মাস মাস্কের চাহিদায় ভাটা পড়েছিল। দামও কমে গিয়েছিল। এখন আবার বাড়তি। এর কারণ, দেশে করোনায় মৃত্যু ও আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে। সরকারও মাস্কের ব্যবহার নিশ্চিত করতে অভিযান শুরু করেছে।
মন্ত্রিসভার বৈঠকে ১৬ নভেম্বর জনসাধারণকে মাস্ক পরাসহ স্বাস্থ্যবিধি মানাতে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার নির্দেশনা দেওয়া হয়। এরপর থেকে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় মাস্ক পরা নিশ্চিত করতে অভিযান চলছে। গতকালও ঢাকার ১৭টি এলাকায় অভিযান পরিচালনা করা হয়। এর মধ্যে ঢাকা জেলা প্রশাসনের অভিযানে মাস্ক না পরার দায়ে ১১১ জনকে ১৮ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। কাউকে কাউকে বিনা মূল্যে মাস্কও দেওয়া হয়।
অভিযানকালে ঢাকা জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট আমেনা মারজান প্রথম আলোকে বলেন, জরিমানার চেয়ে তাঁরা মানুষকে সচেতন ও উদ্বুদ্ধ করার ওপর জোর দিচ্ছেন, যাতে সবাই নিজ থেকেই মাস্ক পরে।
কত রকমের মাস্ক
ব্যবসায়ীরা বলছেন, তিন ধরনের কাপড়ের মাস্ক তৈরি হচ্ছে। নন ওভেন ফেব্রিকসের তৈরি মাস্ক, ওভেন কাপড় (শার্টের কাপড় বলে পরিচিত) ও নিট কাপড়ের মাস্ক (গেঞ্জির কাপড় বলে পরিচিত)। বাবুবাজারে বিভিন্ন দামের এবং মানের অন্তত ১০ ধরনের মাস্ক পাওয়া যাচ্ছে। এর মধ্যে দুই ধরনের মাস্ক আমদানি করা। বাকিগুলো দেশেই তৈরি হয়। সেখানকার বিক্রেতারা নন ওভেন ফেব্রিকসের পাতলা সার্জিক্যাল মাস্ক (টিস্যু কাপড় বলে পরিচিত), মেল্টব্লোন কাপড়ের মাস্ক, কেএন-৯৫ মাস্ক, এন-৯৫ মাস্ক, এন-৯৫থ্রি এম মাস্ক, নিঞ্জা মাস্ক, পিপি ওভেন ফেব্রিকসের মাস্ক, ওভেন কাপড়ের মাস্ক, নিট কাপড়ের মাস্ক এবং সোয়েটারের কাপড়ের মাস্ক বিক্রি করছেন।
দেশের বিভিন্ন পোশাকের ব্র্যান্ডের দোকানেও এখন মাস্ক বিক্রি হয়। যেমন ফ্যাশন ব্র্যান্ড ইয়েলোর ধানমন্ডির বিপণিকেন্দ্রে গিয়ে দেখা যায়, ঢুকতেই হাতের ডান পাশে সুরক্ষাসামগ্রী বিক্রির কর্নার। সেখানে বিভিন্ন ধরনের সার্জিক্যাল ও কাপড়ের মাস্ক বিক্রি হয়।
দরদাম
বাবুবাজারের পাইকারি দোকানে সাধারণ সার্জিক্যাল মাস্ক প্রতিটি ১ টাকা ১০ পয়সা থেকে ৩ টাকা দরে বিক্রি হয়। একই মাস্ক ঢাকার খুচরা দোকানে ৫ থেকে ৭ টাকা দরে বিক্রি করেন বিক্রেতারা। তবে মডেল ফার্মেসি ও ব্র্যান্ডের দোকানে মানভেদে আরও বেশি দামে সার্জিক্যাল মাস্ক বিক্রি করতে দেখা যায়। এটিই বাজারে বেশি চলছে।
এ ছাড়া নন ওভেন ফ্রেবিকসের বিভিন্ন মাস্ক প্রতিটি ২ টাকা ৮০ পয়সা থেকে ৩ টাকা, নিঞ্জা মাস্ক ১৩ থেকে ১৪ টাকা, ওভেন কাপড়ের মাস্ক ৯ থেকে ১০ টাকা, নিট কাপড়ের মাস্ক ৮ থেকে ৯ টাকা এবং দেশে তৈরি কেএন-৯৫ মাস্ক ১৫ থেকে ২০ টাকা, বিদেশ থেকে আমদানি করা এন-৯৫ মাস্ক ৩০০ থেকে ৩৫০ টাকা এবং এন-৯৫থ্রি এম মাস্ক ২৮০ থেকে ৩৫০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে।
ঢাকার ফুটপাতে ১০ থেকে ২০ টাকায় বিভিন্ন কাপড়ের মাস্ক পাওয়া যায়। অন্যদিকে অভিজাত বিপণিগুলোতে বিভিন্ন ধরনের মাস্ক বিক্রি হয় ৭০ থেকে ৫০০ টাকায়। ক্ষুদ্র বস্তুকণা প্রতিরোধী আমদানি করা কেএন-৯৫ মাস্ক এবং এন-৯৫ মাস্ক প্রতিটি ৫০০ থেকে ৮০০ টাকা দরেও বিক্রি করেন অনেকে।
কোথায় তৈরি হয়
করোনা সংক্রমণ শুরুর আগে দেশে গুটিকয় প্রতিষ্ঠান সার্জিক্যাল মাস্ক তৈরি করত। তার মধ্যে একটি ছিল আরএফএল গ্রুপের সহযোগী প্রতিষ্ঠান গেটওয়েল লিমিটেড। তারা দেশে সার্জিক্যাল মাস্ক উত্পাদন শুরু করে ২০১৫ সালে। আরএফএলের পরিচালক কামরুজ্জামান কামাল প্রথম আলোকে বলেন, করোনা সংক্রমণ শুরুর আগে গেটওয়েল প্রতিদিন ১৫ হাজার মাস্ক উত্পাদন করত। এখন করে আড়াই লাখ। বাড়তি চাহিদার কারণে তারা উৎপাদন বাড়িয়েছে।
উৎপাদকেরা জানান, সার্জিক্যাল মাস্কের নন ওভেন কাপড় মূলত চীন থেকে আমদানি করা হয়। এখন ছোট ছোট কারখানায় প্রচুর মাস্ক উৎপাদিত হচ্ছে। অভ্যন্তরীণ বাজারমুখী পোশাক উৎপাদকেরাও করোনাকালে মাস্ক তৈরি শুরু করেন। বাবুবাজারের ব্যবসায়ীরা বলছেন, মাস্ক তৈরির বেশির ভাগ কারখানা ঢাকার কেরানীগঞ্জ, কামরাঙ্গীরচর, গুলিস্তানের সিদ্দিকবাজার, নারায়ণগঞ্জ, টঙ্গী ও গাজীপুরে।
নারায়ণগঞ্জের চট্টগ্রাম টেক্সটাইল নামের একটি কারখানার মালিক মোহাম্মদ মঞ্জুরুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, দুই সপ্তাহ আগে সার্জিক্যাল মাস্কের চাহিদা বাড়ে। এর আগে তিনি ৫০টির এক বাক্স মাস্ক ৬০ টাকায় বিক্রি করেছেন। বর্তমানে তা ১২০ টাকা।
আমদানি পরিস্থিতি
চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের তথ্যে দেখা যায়, মাস্কসহ বিভিন্ন সুরক্ষাসামগ্রীর আমদানি ধারাবাহিকভাবে কমছে। ১ থেকে ২৪ নভেম্বর পর্যন্ত ৪ কোটি ৩৫ লাখ টাকার মাস্ক ও সমজাতীয় পণ্য আমদানি হয়েছে। অক্টোবরে তা ছিল ৮ কোটি ৬৬ লাখ টাকা। এর আগে সেপ্টেম্বর মাসে আমদানি হয়েছিল প্রায় ১১ কোটি টাকার মাস্ক ও সমজাতীয় পণ্য।
মাস্ক আমদানিকারক চট্টগ্রামের সার্ভিস অ্যান্ড করপোরেশনের মালিক জাহেদুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, করোনার শুরুর দিকে বিপুল পরিমাণ মাস্ক আমদানি হয়েছে। এখন দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলো উৎপাদন শুরু করায় আমদানি কমছে।
রপ্তানিও হচ্ছে
করোনায় বিশ্বব্যাপী চাহিদা তৈরি হওয়ায় পিপিই (ব্যক্তিগত সুরক্ষাসামগ্রী) গাউন ও মাস্ক রপ্তানির বড় সম্ভাবনা জেগেছিল। পিপিই গাউনে দু-একটি প্রতিষ্ঠানের বাইরে অন্যরা ভালো সাড়া না পেলেও মাস্কের রপ্তানি বেশ বেড়েছে। তৈরি পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ জানায়, চলতি বছরের মার্চ থেকে জুলাই—এই পাঁচ মাসে ২ কোটি ৬৯ লাখ ডলারের (২২৯ কোটি টাকা) মাস্ক রপ্তানি হয়েছে। গত বছরের একই সময়ে রপ্তানি হয়েছিল ২৭ লাখ ডলারের (২৩ কোটি টাকা) মাস্ক।
জানতে চাইলে বিজিএমইএর পরিচালক মোহাম্মদ নাছির প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা প্রত্যাশা অনুযায়ী পিপিই ও মাস্কের রপ্তানি বাজার ধরতে পারিনি। এ দেশের উদ্যোক্তারা প্রস্তুত হওয়ার আগেই ক্রয়াদেশ চীন, ভিয়েতনাম, শ্রীলঙ্কার মতো প্রতিযোগী দেশে চলে গেছে।’
মান নিয়ে প্রশ্ন
দেশের বাজারে নিম্নমান ও নকল মাস্কও বিক্রি হচ্ছে বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। বাবুবাজারের মিটফোর্ড এলাকায় একটি ফার্মেসির মালিক জাকির হোসেন বলেন, মাস্ক তৈরি ও বিক্রিতে ন্যূনতম একটা নীতিমালা থাকা উচিত।
সরকারি চাকরিজীবী শাহাদাত হোসেন গত সপ্তাহে কেএন-৯৫ মাস্ক কেনেন প্রতিটি ৩৫ টাকা দরে। একবার পরার পরই মাস্কের ফিতা ছিঁড়ে যায়। তিনি বলেন, করোনার শুরুর দিকে তিনি কেএন-৯৫ মাস্ক কিনে অনেক দিন ব্যবহার করেছিলেন। এবার অনলাইনে যা কিনেছেন, তা আসলে নকল।
দেশে মাস্ক তৈরি ও বিক্রিতে বাধ্যতামূলক কোনো মানকাঠামো নেই। বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশনের (বিএসটিআই) বাধ্যতামূলক মান সনদ নেওয়ার তালিকায় যে ১৮১টি পণ্য রয়েছে, সেখানে মাস্ক নেই।
ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান প্রথম আলোকে বলেন, মাস্কের ক্ষেত্রে কয়েক ধরনের মান কাঠামো তৈরি করতে পারে বিএসটিআই। তিনি বলেন, সরকারি উদ্যোগে দরিদ্র মানুষকে আরও বিস্তৃতভাবে মাস্ক দেওয়া দরকার। কারণ, দরিদ্রদের এখন পেট চালানোই দায়। তাদের পক্ষে মাস্ক কেনা সম্ভব নয়। তাদের বিনা মূল্যে দিলে আরও বেশিসংখ্যক মানুষের মাস্ক পরা নিশ্চিত হবে।
[প্রতিবেদনটি তৈরিতে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন নিজস্ব প্রতিবেদক, চট্টগ্রাম ও প্রতিনিধি, নারায়ণগঞ্জ।]