রাজনৈতিক দলগুলোকে শ্রদ্ধাবোধের সংস্কৃতি গড়ে তুলতে হবে: সংসদে রাষ্ট্রপতি
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সোনার বাংলা গড়ে তোলার অঙ্গীকার বাস্তবায়নে ধর্ম-বর্ণ-গোত্র নির্বিশেষে সবার ঐক্য প্রয়োজন বলে মন্তব্য করেছেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ।
স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে আজ বুধবার জাতীয় সংসদে বিশেষ আলোচনায় দেওয়া ভাষণে রাষ্ট্রপতি এ মন্তব্য করেন। বিকেল তিনটার দিকে স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে সংসদের বৈঠক শুরু হয়। এরপর রাষ্ট্রপতি সংসদকক্ষে ঢোকেন। এ সময় জাতীয় সংগীত বাজানো হয়।
রাষ্ট্রপতি তাঁর ভাষণে বলেন, বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়ে তোলার অঙ্গীকার বাস্তবায়নে সবার ঐক্যের প্রয়োজন। এ জন্য রাজনৈতিক দলগুলোকে পরমতসহিষ্ণুতা ও পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধের সংস্কৃতি গড়ে তুলতে হবে। সুশাসন প্রতিষ্ঠায় দল-মতনির্বিশেষে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, সুশীল সমাজ ও অংশীজনদের সমন্বিতভাবে কাজ করে যেতে হবে।
দেশের স্বাধীনতার ইতিহাস তুলে ধরে রাষ্ট্রপতি বলেন, বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে দীর্ঘ ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে, ৩০ লাখ শহীদের জীবন ও ২ লাখ মা-বোনের আত্মত্যাগের বিনিময়ে ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১-এ অর্জিত হয় বাঙালির চূড়ান্ত বিজয়। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন ছিল, দারিদ্র্য ও ক্ষুধামুক্ত, দুর্নীতি ও শোষণহীন এক সমৃদ্ধ বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বাংলার মানুষের মুক্তি অর্থাৎ সোনার বাংলা বিনির্মাণ। স্বাধীনতার অব্যবহিত পরে যুদ্ধবিধ্বস্ত নবীন দেশটির প্রতিকূল পরিস্থিতিতে দেশের দায়িত্বভার গ্রহণ করে বঙ্গবন্ধু মানুষের খাদ্যাভাব দূরীকরণ, সামাজিক অস্থিরতা নিরসন ও আইনশৃঙ্খলার উন্নতিতে নানামুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। দেশ পুনর্গঠনে বিভিন্ন উন্নয়নমুখী নীতি ও আইন প্রণয়ন করে বঙ্গবন্ধু যখন জাতিকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন, তখনই ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট তাঁকে সপরিবারে হত্যা করে ঘাতকেরা তাঁর সেই স্বপ্ন বাস্তবায়ন স্তব্ধ করে দেয়।
দেশের উন্নয়ন চিত্র তুলে ধরে রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ বলেন, সব আশঙ্কা ও নেতিবাচক ভবিষ্যদ্বাণী ভুল প্রমাণ করে বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত স্বপ্ন বাস্তবায়ন করে চলেছেন তাঁর যোগ্য উত্তরসূরি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তাঁর বলিষ্ঠ ও দূরদর্শী নেতৃত্বে বাংলাদেশ দ্রুতগতিতে উন্নয়নের পথে এগিয়ে চলেছে।
দূরদর্শী নেতৃত্বের জন্য প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানিয়ে রাষ্ট্রপতি বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার যোগ্য নেতৃত্বে বাংলাদেশ আর্থ–সামাজিক ক্ষেত্রে ব্যাপক উন্নয়ন করেছে। এখন পৃথিবীর যে ১১টি দেশকে ভবিষ্যৎ উন্নয়নের জন্য ‘উদীয়মান এগারো’ বলা হয় এর মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। গত ১ দশকে গড়ে ৬.৬ শতাংশ ও পরপর ৩ বছর ৭ শতাংশের ওপর প্রবৃদ্ধি অর্জনের পর দেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৮.১৫ শতাংশে উন্নীত হয়। করোনার প্রভাব সত্ত্বেও যে কয়টি দেশ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে, সেগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম।
গত ৫০ বছরে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের চিত্র তুলে ধরে রাষ্ট্রপতি বলেন, বিগত দেড় দশকে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় ৫৪৩ মার্কিন ডলার থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ২ হাজার ৫৫৪ মার্কিন ডলারে এবং জিডিপির আকার ৬ গুণ বৃদ্ধি পেয়ে ৪ লাখ ৮২ হাজার কোটি টাকা থেকে ২৭ লাখ ৯৬ হাজার ৩৭৮ কোটি টাকায় উন্নীত হয়েছে। রপ্তানি প্রায় ৪ গুণ বৃদ্ধি পেয়ে ১০.৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার থেকে প্রায় ৩৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে উন্নীত হয়েছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৭৪৪ মিলিয়ন মার্কিন ডলার থেকে আজ ৪৮ হাজার মিলিয়ন মার্কিন ডলারে দাঁড়িয়েছে, যা এ যাবতকালের সর্বোচ্চ। অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নের বিভিন্ন সূচকে বাংলাদেশ অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জন করেছে এবং কিছু সূচকে বাংলাদেশ প্রতিবেশী দেশগুলোর চেয়ে এগিয়ে রয়েছে।
রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ বলেন, দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। দুর্নীতি দমন কমিশন, জাতীয় মানবাধিকার কমিশন ও তথ্য কমিশন সক্রিয়ভাবে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে। বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলা, যুদ্ধাপরাধী ও মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচারসহ চাঞ্চল্যকর অন্যান্য মামলার রায় দ্রুত নিষ্পত্তি করে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। দুর্নীতি, মাদক, জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাস ও উগ্রবাদ এবং সাম্প্রদায়িকতা প্রতিরোধে সরকারের ‘জিরো টলারেন্স’ নীতির কারণে দেশে স্বস্তি বিরাজ করছে; যা বিশ্বব্যাপী প্রশংসিত হচ্ছে। সুশাসনের উদ্দেশ্যে প্রতিটি সরকারি প্রতিষ্ঠানকে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির আওতায় আনার লক্ষ্যে বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তি, অভিযোগ প্রতিকার ব্যবস্থাপনা, সিটিজেন চার্টার ও শুদ্ধাচার কৌশল বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। সুশাসন প্রতিষ্ঠায় দল-মতনির্বিশেষে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, সুশীল সমাজ ও অংশীজনদের সমন্বিতভাবে কাজ করে যেতে হবে।
রাষ্ট্রপতি বলেন, ২০৩১ সালের মধ্যে চরম দারিদ্র্যের অবসান ও উচ্চ-মধ্য আয়ের দেশ হিসেবে উত্তরণ এবং ২০৪১ সালের মধ্যে দারিদ্র্যের অবলুপ্তিসহ উচ্চ আয়ের দেশের মর্যাদায় আসীন হওয়ার লক্ষ্যে সরকার নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। লক্ষ্য বাস্তবায়নে ২০২১-২০৪১ মেয়াদে জিডিপির প্রবৃদ্ধি ৯ শতাংশে উন্নীত করা প্রয়োজন। উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে উত্তরণের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য আমাদের প্রয়োজন চতুর্থ শিল্পবিপ্লবকে কাজে লাগিয়ে দেশের উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখা। সেই সঙ্গে নিশ্চিত করতে হবে পুষ্টি ও খাদ্যনিরাপত্তা, ব্যাপক শিল্পায়ন, অর্থনীতি সুসংহতকরণ, সুষ্ঠু অবকাঠামো ও জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলাসহ মেধাভিত্তিক সমাজ বিনির্মাণ। এ লক্ষ্যে সবাইকে নিরলসভাবে কাজ করে যেতে হবে।
রাষ্ট্রপতি আরও বলেন, ‘জাতি হিসেবে আমরা এক ঐতিহাসিক মুহূর্ত অতিক্রম করছি। বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীর সোপান বেয়ে আমরা পৌঁছে গেছি স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর স্বর্ণতোরণে। সম্পূর্ণ নিজস্ব অর্থায়নে স্বপ্নের পদ্মা সেতুর নির্মাণ এখন সমাপ্তির পথে। প্রধানমন্ত্রীর দৃঢ় মনোবল, বলিষ্ঠ নেতৃত্বের কারণে পদ্মা সেতু প্রকল্প বাস্তবায়ন হয়েছে। এ সেতুর বাস্তবায়ন জাতি হিসেবে আমাদের স্বকীয়তা, সম্পদ ব্যবস্থাপনা, স্বচ্ছতা, সক্ষমতা, জবাবদিহি, দক্ষতা ও আত্মবিশ্বাসের প্রতীকস্বরূপ; যা মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর সাহস দিয়েছে।’