র্যাম্পে আশরাফুন্নাহারের অভিজ্ঞতাই বলে দেয় বৈষম্য কতটা প্রকট
অস্থায়ী র্যাম্পটি বানানো হয়েছে কাঠ দিয়ে। এই র্যাম্প দিয়েই হুইলচেয়ারে বসে প্রায় ১০টি সিঁড়ি ওঠানামা করলেন প্রতিবন্ধী নারীদের অধিকার আদায়ে কর্মরত ডব্লিউডিডিএফের নির্বাহী পরিচালক আশরাফুন্নাহার। খাঁড়া র্যাম্পে অন্যদের সহায়তায় নামার সময় দুর্ঘটনার আশঙ্কায় আশরাফুন্নাহার ভয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলেন। কিন্তু এমন পরিস্থিতিতেও আশরাফুন্নাহারকে অনুষ্ঠান আয়োজকদের একজন বলেছেন, আপনার জন্য কষ্ট করে এই র্যাম্প বানানো হয়েছে। আশরাফুন্নাহার ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘এ ঘটনায় আমি কষ্ট পেয়েছি।’
আজ বৃহস্পতিবার রাজধানীর সিরডাপ আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রের একটি মিলনায়তনে ঢুকতে গিয়ে আশরাফুন্নাহারকে এ ধরনের পরিস্থিতিতে পড়তে হয়। পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর প্রতি বৈষম্য নিরসনে প্রস্তাবিত বৈষম্যবিরোধী আইন (খসড়া) পর্যালোচনা ও সুপারিশবিষয়ক মতবিনিময় সভায় আশরাফুন্নাহার আলোচনায় অংশ নিয়ে কথাগুলো বলেন।
এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের সমন্বিত পল্লি উন্নয়ন কেন্দ্র বা সিরডাপ ক্যাম্পাসের উন্নয়ন হলেও ভবনগুলো এখনো প্রতিবন্ধীবান্ধব হয়নি বলে আক্ষেপ করেন আশরাফুন্নাহার। তিনি বলেন, সরকার প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অধিকার আদায়ে আইন করেছে, কর্মপরিকল্পনাও করা হয়েছে। তবে বাজেট বরাদ্দের সময় বিভিন্ন স্বল্পতার কথা বলা হয়। সচেতনতা যে বাড়েনি, তার প্রমাণ হিসেবে বলা যায়, অপ্রতিবন্ধী ব্যক্তির মতো মেনে নিতে না পারলে গালি হিসেবে বলা হয়, ‘আরে তুই তো অটিস্টিক বা তুই তো পাগল।’ বৈষম্যবিরোধী আইন প্রণয়ন করলে তাতে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের বৈষম্য নিরসনের কথা সুনির্দিষ্ট করার কথা বলেন আশরাফুন্নাহার।
সিরডাপ মিলনায়তনে ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং ক্রিশ্চিয়ান এইডের সহায়তায় বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট), নাগরিক উদ্যোগ এবং বাংলাদেশ দলিত ও বঞ্চিত জনগোষ্ঠীর অধিকার আন্দোলন (বিডিইআরএম) যৌথভাবে মতবিনিময় সভাটির আয়োজন করে।
সভায় সঞ্চালকের দায়িত্ব পালন করেন নাগরিক উদ্যোগের প্রধান নির্বাহী জাকির হোসেন। আশরাফুন্নাহার বক্তব্য দেওয়ার পর জাকির হোসেন এ ধরনের বিরূপ পরিস্থিতিতে পড়তে হয়েছে বলে আশরাফুন্নাহারের কাছে দুঃখ প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, সিরডাপের একটি ভবনও প্রতিবন্ধীবান্ধব নয়। আশরাফুন্নাহার যাতে সভায় উপস্থিত হয়ে বক্তব্য দিতে পারেন, তাই কাঠের র্যাম্পটি বানানো হয়েছে।
সভায় শুধু আশরাফুন্নাহার নন, সমাজে পিছিয়ে পড়া বৈষম্যের শিকার হওয়া অন্য বক্তারাও সমাজে তাঁদের অবস্থান তুলে ধরেন। সংবিধানে কোনো বৈষম্য করা যাবে না বলে উল্লেখ থাকলেও এই মানুষগুলোকে জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত প্রতি পদে পদে বৈষম্যের শিকার হতে হচ্ছে।
সভায় প্রস্তাবিত বৈষম্যবিরোধী আইন ২০২২ (খসড়া)–এর পর্যালোচনা এবং সুপারিশমালা উপস্থাপন করেন ব্লাস্টের জ্যেষ্ঠ অ্যাডভোকেসি অফিসার আয়শা আক্তার এবং নাগরিক উদ্যোগের প্রকল্প সমন্বয়কারী ইসতিয়াক মাহমুদ।
আলোচকেরা বলেন, ২০১৩ সাল থেকে বিভিন্ন সামাজিক এবং নাগরিক সংগঠন একটি আইন প্রণয়নের দাবি তুলছে। আইন কমিশন, জাতীয় মানবাধিকার কমিশন আইনের পৃথক পৃথক খসড়া তৈরি করে আইন মন্ত্রণালয়ে জমাও দিয়েছিল। তবে বর্তমানে সংসদে উত্থাপিত বিল আর আগের খসড়াগুলোর মধ্যে আকাশ-পাতাল ফারাক। তাই তড়িঘড়ি করে এ আইন প্রণয়ন না করে আরও পরীক্ষা–নিরীক্ষা করে আইনটি প্রণয়ন করতে হবে বলেও উল্লেখ করেন আলোচকেরা।
গত ৫ এপ্রিল আইনমন্ত্রী বৈষম্যবিরোধী বিলের খসড়া জাতীয় সংসদে উত্থাপনের পর থেকে নাগরিক সংগঠনের প্রতিনিধিরা বিলের নানান অসংগতি তুলে ধরতে সভা-সেমিনারের আয়োজন করছেন। সংসদে উত্থাপিত বিলের খসড়াটি পর্যালোচনা করে আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়–সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির ৩০ দিনের মধ্যে মতামত দেওয়ার কথা ছিল। এখনো তা দেওয়া হয়নি। নাগরিক সংগঠনের প্রতিনিধিরা বিলটিকে আইনে পরিণত করতে হলে কোন কোন জায়গায় সংশোধনী ও সংস্কার আনতে হবে, তা–ও লিখিত আকারে জমা দিয়েছেন সংসদীয় স্থায়ী কমিটির কাছে।
আলোচনায় বিডিইআরএমের সাধারণ সম্পাদক উত্তম কুমার ভক্ত বলেন, ‘আমরা এমনই অস্পৃশ্য যে মরলেও আমাদের জাত থাকে। আমাদের জন্য আলাদা শ্মশান করতে হয়। এটা খুবই লজ্জাজনক। উন্মুক্ত স্থানে ধূমপানের জন্যও জরিমানা নির্দিষ্ট করা আছে, আর আমরা যারা জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত বৈষম্যের শিকার হচ্ছি, তাঁদের জন্য যে আইন তাতে জরিমানা, প্রতিকার, শাস্তির বিষয়টিই স্পষ্ট করা হয়নি।’
হিজড়া, ট্রান্সজেন্ডারদের অধিকার আদায়ে কর্মরত সম্পর্কের নয়া সেতুর নির্বাহী পরিচালক জয়া সিকদার আইনের খসড়ায় হিজড়াদের তৃতীয় লিঙ্গ হিসেবে উল্লেখ করায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন। তিনি প্রশ্ন তুলে বলেন, তাহলে পুরুষ প্রথম আর নারীরা কি দ্বিতীয় লিঙ্গ?
আলোচনায় অংশ নিয়ে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের উপপরিচালক সুস্মিতা পাইক বলেন, যে বিলটি সংসদে উত্থাপিত হয়েছে, তা যদি আইনে পরিণত হয় তাহলে আইনটির হাত নেই, পা নেই, কান নেই এমন অবস্থা হবে। আইন কমিশন এবং জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের খসড়া মানবাধিকার কমিশনকে শক্তিশালী করার কথা বলা হলেও বর্তমানের বিলে কমিশনকে বাদ রাখা হয়েছে।
তবে সংসদে উত্থাপিত বিলটি নিয়ে এখন পর্যন্ত মানবাধিকার কমিশন টুঁ শব্দটি করেনি বলে একাধিক আলোচক কমিশনের সমালোচনা করেন।
আলোচনায় মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক শাহীন আনাম বলেন, সমাজে যে বৈষম্যগুলো চলছে, তা প্রচলিত আইনে নিরসন করা সম্ভব হচ্ছে না বলেই নতুন আইন প্রণয়নের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে। তবে এমন একটি আইন প্রণয়নের আগে সমাজের মানুষের মনমানসিকতার পরিবর্তন ঘটাতে হবে। সমতার ভিত্তিতে সমাজ গড়তে হবে—এ ধারণা ধারণ করতে না পারলে সোনা দিয়ে মোড়ানো আইন হলেও তা কাজে লাগবে না।
সভায় সভাপতির বক্তব্যে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী জেড আই খান পান্না প্রস্তাবিত আইনটিতে প্রতিকার প্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রতা কমিয়ে আনা এবং প্রতিকারের বিষয়টি সুনির্দিষ্ট করা জরুরি বলে মত দেন। তিনি প্রতিকার প্রাপ্তির প্রক্রিয়া সহজ করার ওপর জোর দেন। তিনি বলেন, সংবিধানের কোথাও কারও প্রতি বৈষম্যের কথা বলা নেই। তাই সংবিধানকে মেনে আইনের বাস্তবায়ন ঘটাতে হবে।
আলোচনায় অন্যদের মধ্যে সরাসরি এবং অনলাইনে যুক্ত হয়ে বক্তব্য দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মোহাম্মদ গোলাম সারোয়ার, বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং, ক্রিশ্চিয়ান এইডের প্রোগ্রাম ম্যানেজার ফারহানা আফরোজ প্রমুখ।