সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের দুই দিনব্যাপী স্বাধীনতা উৎসবের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান৷ ২৫ মার্চ, কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার, ঢাকা
ছবি: প্রথম আলো৷

মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও বঙ্গবন্ধুর আদর্শ প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখলেও স্বাধীনতার ৫০ বছরে এসে সংস্কৃতিকর্মীদের অবহেলা করা হচ্ছে। মূলধারার সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোকে যথাযথ মর্যাদা দেওয়া হচ্ছে না। স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় স্মৃতিচিহ্নগুলো সংরক্ষণে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ যথেষ্ট নয়। দেশে নানা অনাচার, দুর্নীতি ও অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা দেখা যাচ্ছে।

ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের প্রতি এমন নানা আক্ষেপের কথা বলেছেন, দেশের শীর্ষস্থানীয় সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোর নেতারা। আজ শুক্রবার বিকেলে রাজধানীর কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের দুই দিনব্যাপী স্বাধীনতা উৎসবের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে তাঁরা এসব কথা বলেন৷ এই উৎসবের স্লোগান 'স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী—সমতা সম্প্রীতির বাংলাদেশ'৷

অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সাবেক সভাপতি ও বীর মুক্তিযোদ্ধা নাসির উদ্দীন ইউসুফ বলেন, ঢাকা শহরে কোথাও হেঁটে গেলে ২৫ মার্চের হত্যাযজ্ঞ ও ধ্বংসের কোনো চিত্র খুঁজে পাওয়া যায় না। কিন্তু পৃথিবীর যেসব দেশে যুদ্ধ হয়েছে, প্রতিটি দেশে একেকটি যুদ্ধ-আক্রান্ত শহরে শতাধিক স্থাপনা স্মারক হিসেবে রেখে দেওয়া হয়েছে। আমরা রাখিনি। আমরা গণকবরগুলোও রক্ষণাবেক্ষণ করিনি। এটি বেদনার কথা৷ রাস্তা ও ভবন সবই হবে, কিন্তু একাত্তরের স্মৃতিচিহ্নগুলো রাখলে প্রজন্মের পর প্রজন্ম জেনে যাবে এদেশে ৩০ লাখ মানুষ জীবন দিয়েছিলেন, ২ লাখের বেশি নারী সম্ভ্রম হারিয়েছেন—এসবের বিনিময়েই দেশটা স্বাধীন হয়েছে। অথচ তার কোনো কিছুর অস্তিত্ব বাংলাদেশে নেই৷

ভারত-পাকিস্তানের মতো টেবিলে বসে কলমের খোঁচায় নয়, বাংলাদেশের স্বাধীনতা রক্ত দিয়ে আনতে হয়েছে বলে মন্তব্য করেন নাসির উদ্দীন ইউসুফ। তিনি বলেন, কম্বোডিয়া, থাইল্যান্ড ও সিঙ্গাপুরে যুদ্ধের স্থাপনা আছে। কিন্তু আমরা রাখিনি। ঢাকা শহর যুদ্ধবিধ্বস্ত শহর ছিল না—এটাই আমরা প্রমাণ করতে চাই। তাহলে কি পাকিস্তান সেনাবাহিনী হত্যাযজ্ঞ করেনি? ঢাকা শহরে ঘুরে আমাদের সন্তান বা বিদেশি বন্ধুদের যুদ্ধের কিছু দেখানোর সুযোগ নেই। স্বাধীনতার ৫০ বছরের মধ্যে ২৯ বছর রাজত্ব করেছে স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি। সুতরাং আমাদের অনেক কিছু করা সম্ভব হয়নি। কিন্তু আমরাও তো অনেক দিন ধরে ক্ষমতায় আছি। কী করতে পেরেছি? এটাও আমাদের বলতে হবে।

সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের দুই দিনব্যাপী স্বাধীনতা উৎসবের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান ৷ ২৫ মার্চ, কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার, ঢাকা
ছবি: প্রথম আলো৷

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহ-উপাচার্য (প্রশাসন) ও জাতীয় কবিতা পরিষদের সভাপতি মুহাম্মদ সামাদ বলেন, দুঃখ, বেদনা ও হতাশার মধ্যেও আমাদের শৌর্য-বীর্যের কাহিনিগুলো নতুন প্রজন্মের কাছে বারবারই বলতে হবে। স্মরণ করতে হবে শহীদদের অবদানের কথাও।

দেশে নানা অনাচার, দুর্নীতি ও অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা লক্ষ করা যাচ্ছে বলে মন্তব্য করেন মুহাম্মদ সামাদ।

অনুষ্ঠানের ঘোষণা পাঠ করেন পথনাটক পরিষদের সাধারণ সম্পাদক আহমেদ গিয়াস। এতে বলা হয়, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির পাশাপাশি সাংস্কৃতিক বিকাশের প্রতি অবহেলা ও অদূরদর্শিতা আমাদের শঙ্কিত করে। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে শিল্পী-সাহিত্যিক তথা সংস্কৃতিসমাজের পক্ষ থেকে আমরা রাষ্ট্র ও বিশেষভাবে সরকারের সাংস্কৃতিক দৃষ্টিভঙ্গি নির্ধারণ ও কর্মকাণ্ড পরিচালনায় সম্পৃক্তি ও অংশীদারত্ব প্রতিষ্ঠার দাবি করছি।

অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন সম্মিলিত সংস্কৃতিক জোটের সভাপতি গোলাম কুদ্দুছ। তিনি বলেন, উন্নয়নই শেষ কথা নয়৷ শেষ কথা হলো, মানুষের মধ্যে বৈষম্যকে দূরীভূত করা গেছে কি না। যেসব শিল্পী ও সংগঠন মুক্তিযুদ্ধ করেছেন, পাকিস্তান আমলে রবীন্দ্রসংগীত বন্ধের ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে লড়েছেন এবং বঙ্গবন্ধুর আদর্শ বাস্তবায়নের জন্য লড়াই করেছেন, সেই সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোর কোনো মর্যাদা আজ আমরা যথাযথভাবে দেখছি না। এতে ক্ষতিটা হবে রাষ্ট্রের। কারণ, সংস্কৃতিকর্মীরা হতাশায় নিষ্ক্রিয় হয়ে গেলে দেশকে বাঁচানোর জন্য যে সাংস্কৃতিক জাগরণ দরকার, সেটি করবে কে?

স্বাধীনতা উৎসবের এই উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য দেন সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সহসাধারণ সম্পাদক আহকাম উল্লাহ। এ ছাড়া আরও বক্তব্য দেন উৎসব উদ্‌যাপন পরিষদের আহ্বায়ক ঝুনা চৌধুরী, চারুশিল্পী সংসদের সাধারণ সম্পাদক কামাল পাশা চৌধুরী, গণসংগীত সমন্বয় পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মানজার চৌধুরী, আবৃত্তি সমন্বয় পরিষদের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য রেজীনা ওয়ালী লীনা, নৃত্যব্যক্তিত্ব নিগার চৌধুরী, পথনাটক পরিষদের সভাপতি মিজানুর রহমান প্রমুখ।

আলোচনাপর্ব শেষে শুরু হয় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। ২৫ মার্চের কালরাত স্মরণে আজ এই অনুষ্ঠান হচ্ছে। আগামীকাল শনিবার মহান স্বাধীনতা দিবসেও বিকেল চারটা থেকে শহীদ মিনারে থাকবে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সাংস্কৃতিক আয়োজন।