ডেঙ্গুতে এক সপ্তাহের মধ্যে দুই ছেলে–মেয়েকেই হারালেন এই বাবা–মা
পুতুল, রংপেনসিল, বই–খাতা, ছোট ছোট জামা, জুতা—ঘরে সবই আছে। নেই শুধু এগুলোর মালিক আরাফাত হোসেন রাউফ আর ইসনাত জাহান রাইদা। নেই এই দুজনের খুনসুটি। মায়ের বকুনি থেকে ভাইকে বা বোনকে বাঁচানোর জন্য একজোট হওয়ার কৌশল। ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে ১৮ আগস্ট আরাফাত এবং ২৫ আগস্ট রাইদা মারা গেছে। মা–বাবার সঙ্গে বাইরে ঘুরতে যাওয়া আর খাওয়ার জন্য এই দুই ভাই–বোন প্রতি শুক্রবারের অপেক্ষায় থাকত। আর সেই শুক্রবারেই দুজন চলে গেল।
মোহাম্মদ ইব্রাহিম ও রাবেয়া আক্তার দম্পতির রাজধানীর মধ্য পাইকপাড়ার ছাপাখানা মোড়ের বাসাটিতে শুধুই পিনপতন নীরবতা। ডেঙ্গুতে দুই ছেলে–মেয়েকে হারিয়ে এই বাবা–মা বেশিক্ষণ ঘরে থাকতে পারেন না। কোনো না কোনো আত্মীয়ের বাসা বা সাভারের হেমায়েতপুরে চলে যান, যেখানে পাশাপাশি দুই ভাই–বোনকে কবর দেওয়া হয়েছে। বাসার কাছেই আইকন একাডেমি নামে একটি স্কুলে আরাফাত হোসেন কেজি আর রাইদা নার্সারিতে পড়ত। আরাফাতের বয়স ছিল ৯ বছর আর রাইদার ছিল সাড়ে ৬ বছর।
আজ বুধবার দুপুরে মধ্য পাইকপাড়ার বাসাটিতে গেলে এই দুই সন্তানের মা রাবেয়া আক্তার পুরো সময় প্রায় কোনো কথাই বলেননি। একটু পরপর মুঠোফোনে ছেলে–মেয়ের ছবি আর ভিডিও দেখে চোখের পানি ফেলছিলেন। ছেলে–মেয়েদের খাতা খুলে একবার বললেন, ‘দেখছেন, আমার বাচ্চাদের হাতের লেখা কত সুন্দর ছিল।’ বিকেলবেলায় বাসাটি থেকে বের হওয়ার সময় এই মা শুধু বললেন, চারপাশে ছেলে–মেয়েদের কত স্মৃতি!
বাবা মোহাম্মদ ইব্রাহিম বললেন, ‘ডেঙ্গুতে এক সপ্তাহের ব্যবধানে ছেলে–মেয়ে দুজনকেই তো হারিয়ে ফেললাম।’ ঘরের যেখানে হাত দেন, সেখানেই ছেলে–মেয়েদের নিয়ে নানা স্মৃতির কথা বলছিলেন এই বাবা। খাবার টেবিলে বাবার দুই পাশে দুজন বসত, মুখে তুলে খাইয়ে দিতে হতো। কোলবালিশ দেখিয়ে বললেন, কোলবালিশ মাথায় দিয়ে তাঁকে শুতে হতো, এক হাতের ওপর মেয়ে, আরেক হাতের ওপর ছেলে ঘুমাত।
এই বাবা বললেন, ‘আমার টাকাপয়সা খুব বেশি নেই। যেটুকু ছিল বা সামর্থ্য অনুযায়ী ছেলে–মেয়েদের নিয়ে সুখে থাকতে চাইতাম। প্রতি শুক্রবার স্ত্রী ও দুই ছেলে–মেয়েকে নিয়ে বের হতাম। বাইরে ঘুরে, খেয়েদেয়ে বাসায় ফিরতাম।’
ছেলে–মেয়েদের নিয়ে প্রথমে রিকশায় ঘুরতেন জানিয়ে মোহাম্মদ ইব্রাহিম বলেন, ঘোরার সুবিধার জন্য মোটরসাইকেল কেনেন। কিন্তু মোটরসাইকেলে জায়গা না হওয়ায় গাড়ি কিনেছিলেন শুধু ছেলে–মেয়েদের নিয়ে মনমতো ঘুরতে পারবেন বলে।
‘এখন আর শুক্রবারে আমাদের করার কিছু রইল না,’ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন এই বাবা।
আক্ষেপ করে মোহাম্মদ ইব্রাহিম বললেন, ‘আগে আমাদের কোনো অভাব ছিল না। দুঃখ ছিল না। এক সপ্তাহের ব্যবধানে দুই ছেলে–মেয়েকে হারিয়ে এখন আমাদের মতো অভাবী আর দুঃখী আর কেউ নেই। আমাদের মনের যে কষ্ট, তা ভুক্তভোগী ছাড়া কেউ বুঝতেও পারবে না।’
মোহাম্মদ ইব্রাহিম জানালেন, আগামী ২৭ সেপ্টেম্বর ছিল ছেলে আরাফাতের জন্মদিন। ছেলেটার ৯ বছর বয়স হতো। ছেলে উড়োজাহাজে করে সিলেট গিয়ে জন্মদিনের অনুষ্ঠান করতে চেয়েছিল। তা আর হলো না।
ইব্রাহিম কিছুদিন আগে এক হোটেলে খেয়ে বুঝতে পেরেছিলেন, হোটেলের খাবার অনেক মজার। তাই ভেবেছিলেন, স্ত্রী ও ছেলে–মেয়েকে নিয়ে ওই হোটেলে খেতে যাবেন। তা–ও তো হলো না। ছেলে–মেয়ের অ্যাকুয়ারিয়ামে দুটো মাছ ছিল। ছেলে–মেয়ে দুটোকে নিয়ে হাসপাতালে দৌড়াতে গিয়ে মাছ দুটোও মরে গেছে। এই মা–বাবা ভাবছেন, মাছগুলোও হয়তো চোখের সামনে থেকে ছেলে–মেয়ে দুটো নাই হয়ে গেছে, সেই শোক সইতে পারেনি বলেই মারা গেছে।
১৫ আগস্টেও এই দম্পতি ছেলে–মেয়েদের নিয়ে বাইরে ঘুরতে গিয়েছিলেন। সন্তানদের সঙ্গে সেদিনই তাঁরা শেষ ছবি তুলেছিলেন। রাবেয়া আক্তার মুঠোফোনটি কাছে এনে ছবি দেখিয়ে বললেন, মেয়েটা লম্বায় প্রায় মায়ের সমান হয়ে গিয়েছিল। এই যে দেখেন, ছেলেটা তার মাকে চুমু দিচ্ছে। তারপর একা একাই বললেন, ‘বাসায় তো প্রায় সময় আমরা তিনজনই থাকতাম। কত মজা করতাম! ছবি তুলতাম। ভিডিও করতাম। এখন এই ঘরে আমি একা কীভাবে থাকব?’
১৪ আগস্ট আরাফাতের হালকা জ্বর আসে। ১৫ আগস্ট এলাকার এক চিকিৎসকের কাছে নেওয়া হয়। ১৬ আগস্ট রক্তের পরীক্ষায় ডেঙ্গু পজিটিভ আসে। প্লাটিলেট ভালো থাকায় চিকিৎসক বলেছিলেন, হাসপাতালে নেওয়ার দরকার নেই। কিন্তু পরের দিন ১৭ আগস্ট প্লাটিলেট দ্রুত কমতে থাকে। ১৮ আগস্ট হাসপাতালে ভর্তি করার আগেই আরাফাত মারা যায়। হাসপাতালে নেওয়ার পর চিকিৎসকেরা জানান, ছেলে মারা গেছে।
মোহাম্মদ ইব্রাহিম বললেন, ‘ছেলেটা চিকিৎসা করানোর কোনো সুযোগই দিল না। ছেলেটা মারা যাওয়ার পর আমি আর আমার স্ত্রী ভেবেছি, হয়তো আমরা তার চিকিৎসায় কিছুটা হলেও অবহেলা করেছি। তাই মেয়ের ডেঙ্গু পজিটিভ হলে চেষ্টার কোনো ত্রুটি করিনি। কিন্তু হাসপাতালে শয্যা নেই, শিশুদের পিআইসিইউ নেই, পাগলের মতো কত জায়গায় ঘুরলাম। ছেলে মারা যাওয়ার খবর পাওয়ার পরও কোনো কোনো হাসপাতাল আমাদের জিম্মি করে রাখল। চিকিৎসকেরা যখন যা লাগবে বলেছেন, তা–ই করেছি, কিন্তু মেয়েকেও ফেরাতে পারলাম না।’
রেন্ট–এ–কার ব্যবসায়ী মোহাম্মদ ইব্রাহিম জানালেন, ধানমন্ডির একটি হাসপাতালের পিআইসিইউতে মেয়েকে পাঁচ দিন রেখে মেয়ে ভালো আছে বলে বাসায় আনতে বলে। তবে মেয়েকে বাসায় আনার পরই আবার অসুস্থ হয়ে পড়ে। তখন মহাখালীর আরেকটি বেসরকারি হাসপাতালের পিআইসিইউতে ভর্তি করা হয়। ওই হাসপাতাল তিন লাখ টাকা দিয়ে সাতটি ইনজেকশন দেওয়ার কথা বলেছিল। দুটি ইনজেকশন দেওয়াও হয়। তবে ২৫ আগস্ট সকালে মেয়ে মারা গেল।
এই বাবা বললেন, ছেলে–মেয়ে দুটো একজন আরেকজনকে ছাড়া একমুহূর্ত থাকতে পারত না। তাই হয়তো কাছাকাছি সময়ে তারা চলে গেছে। মারা যাওয়ার পর দুই ভাই–বোনকে সাভারের হেমায়েতপুরে পাশাপাশি কবর দেওয়া হয়েছে।
‘আমার দুই পাখিই চলে গেল’ বলে মোহাম্মদ ইব্রাহিম বলেন, ‘আমার ছেলে–মেয়ের হায়াত ছিল না, সৃষ্টিকর্তা তাদের নিয়ে গেছেন। কিন্তু আমাদের দেশের বেশির ভাগ হাসপাতালগুলোর খুবই খারাপ দশা। টাকা থাকলেও ভালো চিকিৎসা না পেয়ে আমার মেয়েটা মরে গেল, এটাই মেনে নিতে পারছি না। মেয়ে মারা যাওয়ার আগে ঢাকায় মশার জন্য আর এই শহরে থাকতে চায়নি। হেমায়েতপুরে আমার ভাইয়ের কাছে চলে যেতে চাইত। ছেলে–মেয়ে দুটো চলে গিয়ে আমাদের জীবনটা উল্টাপাল্টা হয়ে গেল।’
মোহাম্মদ ইব্রাহিম আক্ষেপ করে বলেন, আগে মশা মারার জন্য মাঝেমধ্যে এলাকায় সিটি করপোরেশনের লোক আর কিছু না হোক কিছু ধোঁয়া দিতেন। এখন সেটারও দেখা পাওয়া যায় না। আর কোনো মা–বাবার যাতে বুক খালি না হয়, বুক খালি হওয়া বাবা ও মায়েদের কষ্টটা একটু অনুভব করে হলেও যাতে সরকারের সংশ্লিষ্ট সবাই মশা মারে, সে আহ্বান জানান তিনি।
মোহাম্মদ ইব্রাহিম নিজের মুঠোফোনে ছেলে ও মেয়ের ছবি দিয়ে একটি গজল রেকর্ড করেছেন। গজলের মূল কথা হচ্ছে, এই দুনিয়ায় আর দেখা হবে না, জান্নাতের ফুলবাগানে আবার হয়তো তাঁদের চারজনের দেখা হবে। জানালেন, হেমায়েতপুরে একটি জায়গা কিনেছিলেন, সেখানে মেয়ের রুমটা গোলাপি আর ছেলের রুমটা নীল রং দিয়ে সাজাতে চেয়েছিলেন। বড় কলিজা আর ছোট কলিজা বলে ডাকা ছেলে–মেয়ের জন্য সেই ঘরও আর বানানো হলো না।