এক দিনে ৩০ লাখের বেশি মানুষকে করোনার টিকা দেওয়া হয়েছে। ঘটনাটি অনেক বড়। এটা বাংলাদেশের স্বাস্থ্য বিভাগের টিকাদানের সক্ষমতার প্রমাণ। শিশুদের টিকা দেওয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অভিজ্ঞতা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সমাদৃত। বাংলাদেশ সেই অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়েছে।
গতকাল শনিবার টিকা কেন্দ্রগুলোতে মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত উপস্থিতি, ভিড় এটাই প্রমাণ করে যে মানুষ টিকা নিয়ে নিরাপদে থাকতে চান। প্রতিদিনের দুই শতাধিক মানুষের মৃত্যুর খবরে অনেকেই চিন্তিত। মানুষ এ খবর আর শুনতে চান না। এত দিনে মানুষ জেনে গেছেন, টিকা তাঁকে সুরক্ষা দেবে। তাই বৃষ্টি উপেক্ষা করে, হাঁটুপানিতে লাইনে দাঁড়িয়ে, ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করে দেশের মানুষ টিকা নিয়েছেন। এখন প্রয়োজন মানুষের এই আগ্রহকে ধরে রাখা। মানুষকে নিয়মিত টিকা দেওয়া, বহু মানুষকে টিকার আওতায় আনা। সরকার অবশ্য বলেছে, দেশের ৮০ শতাংশ মানুষকে টিকার আওতায় আনার পরিকল্পনা তাদের আছে।
গত ৭ ফেব্রুয়ারি থেকে করোনার টিকা দেওয়া শুরু করে সরকার। উপজেলা সরকারি হাসপাতাল, জেলা ও সদর হাসপাতাল, সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও রাজধানীর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিশেষায়িত হাসপাতালগুলোতে এবং কিছু সরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানে টিকা দেওয়া চলছিল। কিন্তু যে পরিমাণ মানুষকে টিকা দেওয়া চলছিল, তা জনসংখ্যার তুলনায় ছিল কম। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দিল্লির আঞ্চলিক কার্যালয় তাদের সর্বশেষ হিসাবে বলেছে, দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে দুই ডোজ টিকা পাওয়া মানুষের হার সবচেয়ে কম বাংলাদেশে।
বেশি মানুষকে টিকা দেওয়ার ক্ষেত্রে এখন প্রথম প্রশ্ন হচ্ছে, টিকার মজুত কত? কত টিকা পাইপলাইনে আছে? কোন সময়ে কত টিকা আসবে? একবারে কয়েক কোটি টিকা চলে এলে তা সংরক্ষণ বা মজুত করার সক্ষমতা স্বাস্থ্য বিভাগের আছে কি না?
গতকাল এটাই প্রমাণ হয়েছে যে বাংলাদেশ দিনে কমপক্ষে ৩০ লাখ মানুষকে টিকা দিতে সক্ষম। সরল পাটিগণিতের হিসাব বলে, সপ্তাহে ছয় দিন টিকা দিলে এক কোটি ৮০ লাখ মানুষকে টিকা দেওয়া যায়। এটা কি সম্ভব? উত্তর হলো সম্ভব। হাম-রুবেলার টিকা ক্যাম্পেইনের সময় দিনে প্রায় দুই কোটি শিশুকে টিকা দেওয়া হয়। স্বাস্থ্য বিভাগ সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচির মডেলকেই ব্যবহার করতে চেয়েছে। আপাতত তারা সফল।
অব্যবস্থাপনার কিছু অভিযোগ গণমাধ্যমে এসেছে। কেন্দ্রে আসা মানুষের চেয়ে টিকার পরিমাণ ছিল খুবই কম। কোনো কেন্দ্রে মানুষ এসেছে চার হাজার বেশি, টিকা ছিল ৩৫০। দুই ঘণ্টার মধ্যে টিকা দেওয়া শেষ। এর অর্থ টিকা থাকলে ওই চার হাজার মানুষকেই টিকা দেওয়া সম্ভব হতো।
শনিবারের ঘটনার একটি তাৎপর্যপূর্ণ দিক হচ্ছে জনপ্রতিনিধিদের সম্পৃক্ততা। জনস্বাস্থ্যবিদেরা মহামারির শুরু থেকে বলে আসছেন, জনপ্রতিনিধিদের সম্পৃক্ত করা সম্ভব হলে মহামারি প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ তুলনামূলকভাবে সহজ হবে। জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে মানুষের নিয়মিত যোগাযোগ থাকে। সাধারণ মানুষ অনেকেই জনপ্রতিনিধিদের ডাকে সাড়া দেন। শনিবার তার প্রমাণ পাওয়া গেছে।
করোনার নিয়মিত টিকাকেন্দ্রের বাইরে গতকাল ৪ হাজার ৬০০টি ইউনিয়ন, ১ হাজার ৫৪টি পৌরসভা এবং ১২টি সিটি করপোরেশনের ৪৩৩টি ওয়ার্ডে টিকা দেওয়ার কথা ছিল। ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান, সদস্য এবং শহর এলাকায় ওয়ার্ড কাউন্সিলররা মানুষকে কেন্দ্রে আনতে, নিবন্ধনে সহায়তা করেছেন। অনেকে টিকাকেন্দ্রে বৈদ্যুতিক পাখা, খাবার ও পানীয়ের ব্যবস্থা করেছেন।
বেশি মানুষকে টিকা দেওয়ার ক্ষেত্রে এখন প্রথম প্রশ্ন হচ্ছে, টিকার মজুত কত? কত টিকা পাইপলাইনে আছে?
টিকাকেন্দ্রগুলোতে মানুষের উপচে পড়া ভিড় দেখে এখন এটা বলার সময় এসেছে যে টিকা নিয়ে মানুষের দ্বিধা নেই। মহামারি মোকাবিলায় টিকা ব্যবহারের শুরুর দিকের আলোচনায় ‘ভ্যাকসিন হ্যাজিটেন্সি’ নিয়ে কথা উঠেছিল। অর্থাৎ টিকা নিয়ে মানুষের মধ্যে কোনো দ্বিধাদ্বন্দ্ব আছে কি না, টিকায় কাজ হবে কি না, টিকা নিলে মানুষ কত দিন নিরাপদে থাকবে, টিকা নিলে তীব্র কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দেবে কি না, এসব প্রশ্নের স্পষ্ট উত্তর জানা না থাকলে মানুষ টিকা নেওয়া থেকে বিরত থাকতে পারে। মানুষের স্বতঃস্ফূর্ততা দেখে এখন বলা যায়, টিকার কার্যকারিতার ব্যাপারে মানুষের মনে কোনো সন্দেহ নেই।
সবকিছু ছাপিয়ে টিকাপ্রাপ্তির বিষয়টি এখন বড় হয়ে দেখা দিয়েছে। দেশের মোট জনসংখ্যার ৮০ শতাংশকে, অর্থাৎ ১৩ কোটির বেশি মানুষকে দুই ডোজ করে টিকা দিতে ২৬ কোটির বেশি টিকার প্রয়োজন হবে। সেই পরিমাণ টিকা কি বাংলাদেশ পাবে, পেলে কত দিনে পাবে? টিকা পেলে অল্প সময়ে দেশের সব মানুষকে টিকার আওতায় আনা সম্ভব হবে, এটা স্বাস্থ্য বিভাগ দেখিয়ে দিয়েছে।
গণমাধ্যমে খবর বেরিয়েছে, কিছু মানুষ টিকাকেন্দ্রে আসতে পারেননি। তাঁরা বৃদ্ধ, তাঁরা প্রতিবন্ধী। স্বাস্থ্যকর্মীরা এসব মানুষের বাড়িতে গিয়ে টিকা দিয়েছেন। মহামারিকালে এর চেয়ে বড় খবর আর কী হতে পারে।