এক মাস ধরে রোগী শনাক্তের হার কম

করোনাভাইরাসের প্রতীকী ছবি

এক মাস ধরে দেশে দৈনিক করোনা রোগী শনাক্তের হার ২০ শতাংশের নিচে রয়েছে। তবে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দৈনিক নমুনা পরীক্ষার বিপরীতে রোগী শনাক্তের যে তথ্য সরকার দিচ্ছে, সেটি সংক্রমণের বাস্তবচিত্র নির্দেশ করছে না।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, লোকজনের মধ্যে স্বাস্থ্যবিধি মানা নিয়ে উদাসীনতা বেড়েছে। করোনায় আক্রান্ত ব্যক্তিদের সংস্পর্শে এসেছেন, এমন সন্দেহভাজনদের শনাক্তকরণের (কন্ট্যাক্ট ট্রেসিং) কাজ ঠিকভাবে হচ্ছে না। যাঁদের উপসর্গ মৃদু, তাঁরা পরীক্ষাও করাতে চাইছেন না। এতে সংক্রমণে ঝুঁকি থেকেই যাচ্ছে।

এর মধ্যেই কোভিড-১৯ চিকিৎসার জন্য নির্ধারিত হাসপাতালের সংখ্যা আরও কমিয়ে আনছে সরকার। গত মঙ্গলবার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এক প্রজ্ঞাপনে জানায়, শয্যাগুলোতে রোগী না থাকায় বসুন্ধরা কোভিড হাসপাতাল, মিরপুরের লালকুঠি হাসপাতাল ও ঢাকা মহানগর হাসপাতালে কোভিড কার্যক্রম বন্ধ করা হয়েছে। এর ফলে সরকারি ব্যবস্থাপনায় রাজধানীর ১১টি হাসপাতালে করোনার চিকিৎসা চালু থাকবে। কিছুদিনের মধ্যে শয্যাসংখ্যা আরও কমিয়ে আনা হবে বলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে।

গতকাল শুক্রবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নিয়মিত বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, গত ২৪ ঘণ্টায় ১ হাজার ৫৪১ জনের করোনার সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছে। পরীক্ষার বিপরীতে শনাক্তের হার ১২ দশমিক ১১ শতাংশ। গত ২৪ ঘণ্টায় দেশে করোনায় মারা গেছেন ২২ জন। সব মিলিয়ে এ পর্যন্ত মারা গেছেন ৪ হাজার ৮৮১ জন। এখন পর্যন্ত সুস্থ হয়েছেন ২ লাখ ৫২ হাজার ৩৩৫ জন। গত ২৪ ঘণ্টায় সুস্থ হয়েছেন ১ হাজার ৯২৩ জন।

গত ৮ মার্চ দেশে প্রথম কোভিড-১৯ রোগী শনাক্তের তথ্য জানায় সরকার। শুরুর দিকে পরীক্ষার তুলনায় সংক্রমণ শনাক্তের হার কম ছিল। মে মাসের শেষ সপ্তাহে দৈনিক সংক্রমণ শনাক্তের হার ২০ শতাংশের ওপরে চলে যায়। গত ২০ আগস্ট পর্যন্ত কয়েক দিন বাদে দৈনিক সংক্রমণ শনাক্তের হার ছিল ২০-২৫ শতাংশ। গত ২১ আগস্ট থেকে দৈনিক করোনা রোগী শনাক্তের হার ২০ শতাংশের নিচে থাকছে।

শনাক্তের হার কমে আসার কিছু কারণ রয়েছে বলে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। তাঁরা বলছেন, লোকজন বিদেশ যাওয়ার আগে পরীক্ষা করাচ্ছেন। তাঁদের প্রায় শতভাগ করোনা নেগেটিভ হচ্ছেন।

দৈনিক সংক্রমণের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, গত ২০ আগস্ট শনাক্তের হার ছিল ২০ দশমিক ৪০ শতাংশ। এর পরের সপ্তাহে শনাক্তের হার ছিল ১৮ থেকে ১৬ শতাংশ। সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহে শনাক্তের হার ছিল ১৫ থেকে ১৪ শতাংশ। সেপ্টেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে শনাক্তের হার ১২ থেকে ১০ শতাংশের মধ্যেই থাকছে।

শনাক্তের হার কমে আসার কিছু কারণ রয়েছে বলে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। তাঁরা বলছেন, লোকজন বিদেশ যাওয়ার আগে পরীক্ষা করাচ্ছেন। তাঁদের প্রায় শতভাগ করোনা নেগেটিভ হচ্ছেন। নন-কোভিড রোগীদের চিকিৎসা নেওয়ার আগে করোনা পরীক্ষা করাতে হচ্ছে। করোনা শনাক্ত অনেক রোগী আইসোলেশন শেষে সুস্থ হয়েছেন কি না, সেটি দেখতেও পরীক্ষা করাচ্ছে।

সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) পরামর্শক ও রোগতত্ত্ববিদ মুশতাক হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, কিছুদিন ধরে রোগী শনাক্তের হার কিছুটা কমেছে। কিন্তু সংক্রমণ কমছে, এখনো সেটা বলা যাবে না। কখনো কখনো সংক্রমণের গতি ধীর হতে পারে। কিন্তু সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগ না নিলে শনাক্তের হার ৫ শতাংশের নিচে আসতে অনেক সময় লাগবে। টানা তিন সপ্তাহ এমন পরিস্থিতি থাকলে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে এসেছে বলে ধরা হয়।

কিছুদিন ধরে রোগী শনাক্তের হার কিছুটা কমেছে। কিন্তু সংক্রমণ কমছে, এখনো সেটা বলা যাবে না। কখনো কখনো সংক্রমণের গতি ধীর হতে পারে। কিন্তু সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগ না নিলে শনাক্তের হার ৫ শতাংশের নিচে আসতে অনেক সময় লাগবে।
মুশতাক হোসেন, সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) পরামর্শক ও রোগতত্ত্ববিদ

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের গতকালের বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, সারা দেশে করোনার জন্য নির্ধারিত হাসপাতালগুলোতে শয্যা রয়েছে ১৪ হাজার ২৫৫টি। আর নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র (আইসিইউ) রয়েছে ৫৪৭টি। এর মধ্যে সাধারণ শয্যায় রোগী ভর্তি রয়েছে ২ হাজার ৯৯২ জন। আর আইসিইউতে রোগী রয়েছে ২৯২ জন।

চীনে করোনাভাইরাস সংক্রমণ শুরু হলে প্রস্তুতি হিসেবে গত ৬ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালকে কোভিড-১৯ বিশেষায়িত হাসপাতাল নির্ধারণ করে সরকার। পরে কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালসহ কয়েকটি সরকারি হাসপাতালকে কোভিড বিশেষায়িত হাসপাতাল ঘোষণা করে সরকার। রোগীর সংখ্যা বাড়তে থাকায় কোভিড-১৯ আক্রান্ত ব্যক্তিদের চিকিৎসা দিতে বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতালকেও অনুমোদন দেয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।

গত ২৬ জুন প্রথমবারের মতো কোভিড হাসপাতালের চার ভাগের তিন ভাগ শয্যা ফাঁকা বলে জানান স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক নাসিমা সুলতানা। সেদিন দেশে করোনার সাধারণ শয্যার ৭০ শতাংশ ফাঁকা ছিল। এরপর থেকে গতকাল পর্যন্ত অধিকাংশ দিন ৭০ থেকে ৭৩ শতাংশ শয্যা ফাঁকা ছিল।

শয্যা ফাঁকা থাকায় গত মাসের শেষ থেকে কোভিড-১৯ চিকিৎসার জন্য নির্ধারিত শয্যা কমাতে শুরু করে সরকার। ২৪ আগস্ট সাধারণ শয্যা ছিল ১৫ হাজার ২৫৫টি। আর ২ সেপ্টেম্বর শয্যা ছিল ১৪ হাজার ৪৭৪টি। সর্বশেষ যে তিনটি হাসপাতালে কোভিড চিকিৎসা কার্যক্রম বন্ধ করা হয়েছে, সেগুলোর মধ্যে বসুন্ধরা কোভিড হাসপাতালে ২ হাজার ১৩ শয্যা, মিরপুরের লালকুঠি হাসপাতালে ১২১ শয্যা এবং মহানগর হাসপাতালে ৬৬টি শয্যা করোনার জন্য নির্ধারিত ছিল। করোনার জন্য নির্ধারিত চট্টগ্রামের একাধিক হাসপাতালে কোভিড চিকিৎসা বন্ধ করা হবে বলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে।