রাজধানীতে সংক্রমণ বাড়ছে

রাজধানীতে এক মাসে রোগী বেড়েছে ৫৬%। মিরপুর, মোহাম্মদপুর, ধানমন্ডি, উত্তরায় আক্রান্ত বেশি। দেশে মোট আক্রান্তের ৩৪.৬৫% রাজধানীর বাসিন্দা।

দেশে মহামারির শুরু থেকেই রাজধানী ঢাকায় করোনাভাইরাসের সংক্রমণ বেশি ছিল। সারা দেশে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে রাজধানীতে আক্রান্তের হার কমতে দেখা যায়। কিন্তু স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার বিষয়গুলো শিথিল হওয়ায় পরিস্থিতি পাল্টে যেতে দেখা যাচ্ছে। রাজধানীতে আবার সংক্রমণ বাড়ছে। গত এক মাসে রাজধানীতে কোভিড-১৯ আক্রান্ত রোগী বেড়েছে ৫৬ শতাংশ। এই তথ্য সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর)।

আইইডিসিআরের হিসাবে পুরো রাজধানীতেই সংক্রমণ ছড়িয়েছে। প্রায় সব এলাকায় নিশ্চিত আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে। তবে মিরপুর, মোহাম্মদপুর, ধানমন্ডি, উত্তরায় আক্রান্তের সংখ্যা বেশি।

রাজধানীর জীবনযাত্রা মহামারি শুরুর প্রায় আগের অবস্থায় চলে এসেছে। রাস্তায় মানুষের ঢল আর যানজট অনেকটা আগের মতো। খুব কম মানুষ মাস্ক পরে রাস্তায় বের হচ্ছেন। সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে চলার বিষয়টি গুরুত্ব হারিয়েছে। কাঁচাবাজার শুধু নয়, অফিস ও ব্যাংক পাড়াতেও পুরোপুরি স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে দেখা যাচ্ছে না। মানুষ অনেকটা বেপরোয়া মনোভাব নিয়ে চলাফেরা–যাতায়াত করছে। করোনা সংক্রমণ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণে তেমন কোনো সরকারি উদ্যোগ মানুষ দেখতে পাচ্ছে না, মানুষের সামনে কোনো বিধিনিষেধ কার্যত নেই। তাই বিশ্বের অন্যতম ঘনবসতিপূর্ণ এই শহরে সংক্রমণ থেমে নেই।

গত ৮ মার্চ দেশে প্রথম করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শনাক্তের কথা নিশ্চিত করে সরকার। ক্রমে সংক্রমণ বাড়তে থাকে। গত ৫ এপ্রিল পাঁচটি জায়গাকে সংক্রমণের ক্লাস্টার (কাছাকাছি একই জায়গায় অনেক আক্রান্ত) হিসেবে চিহ্নিত করেছিল আইইডিসিআর। এর দুটি টোলারবাগ ও বাসাবো ছিল রাজধানীতে। বাকি তিনটি ছিল নারায়ণগঞ্জ, মাদারীপুরের শিবচর এবং গাইবান্ধার সাদুল্যাপুর।

ক্লাস্টার থেকে সামাজিক সংক্রমণ হয়েছে অনেক আগেই। এখন দেশে নিশ্চিত আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ৯৭ হাজার ৮৩ জন। তাঁদের মধ্যে মারা গেছেন ৩ হাজার ৯৮৩ জন। আর সুস্থ হয়েছেন ১ লাখ ৮২ হাজার ৮৭৫ জন।

দেশে নিশ্চিত আক্রান্ত বা ইতিমধ্যে যাঁদের সংক্রমণ চিহ্নিত হয়েছে, তাঁদের এলাকাভিত্তিক হিসাব প্রকাশ করে আইইডিসিআর। যদিও সব এলাকাভিত্তিক হিসাব নেই। গতকাল সোমবার পর্যন্ত আক্রান্ত প্রায় ৩ লাখ মানুষের মধ্যে ২ লাখ ১৮ হাজার ১২২ জনের এলাকাভিত্তিক তথ্য দিয়েছে আইইডিসিআর। তাঁদের মধ্যে ৭৫ হাজার ৫৮৬ জন রাজধানী ঢাকার বাসিন্দা।

গত ২২ জুলাই পর্যন্ত রাজধানীতে মোট আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ৪৮ হাজার ৩২২ জন। অর্থাৎ এক মাসের ব্যবধানে এখানে ২৭ হাজার ২৬৪ জন রোগী বেড়েছে। শতকরা হিসাবে আগের সাড়ে চার মাসের তুলনায় এই এক মাসে রাজধানীতে রোগী বেড়েছে ৫৬ শতাংশ।

মাঝখানে ঢাকার বাইরের তুলনায় রাজধানীতে সংক্রমণ কিছুটা কমতির দিকে ছিল। ২৭ মে পর্যন্ত দেশে মোট আক্রান্তের ৫৪ শতাংশ ছিল রাজধানীর বাসিন্দা।

২৯ জুলাই পর্যন্ত সময়ে সেটি কমে ৩১ শতাংশে নেমেছিল। এখন মোট আক্রান্তের সংখ্যায় রাজধানীর অংশ আবার বাড়ছে। এখন দেশে মোট আক্রান্তের ৩৫ শতাংশ রাজধানীর বাসিন্দা।

তবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর নমুনা পরীক্ষার ওপর নির্ভর করে আক্রান্তের যে সংখ্যা দেয়, প্রকৃত আক্রান্তের সংখ্যা তার চেয়ে বেশি। সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর) ও আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশের (আইসিসিডিআরবি) যৌথ জরিপের প্রাথমিক ফলাফলে ১০ আগস্ট বলা হয়, রাজধানীর আনুমানিক ৯ শতাংশ মানুষ করোনায় আক্রান্ত। বিশ্বব্যাংকের হিসাবে ২০১৭ সালে ঢাকা মহানগরের জনসংখ্যা ১ কোটি ৮০ লাখ। সে হিসাবে রাজধানীতে আক্রান্তের সংখ্যা ১৬ লাখ ২০ হাজার।

আক্রান্তের সংখ্যার দিক থেকে বাংলাদেশ বিশ্বে ১৫তম। মৃত্যুর সংখ্যার দিক থেকে ২৯তম।
সূত্র: জনস হপকিনস বিশ্ববিদ্যালয়

সংক্রমণ বেশি যেসব এলাকায়

আইইডিসিআরের ২৩ আগস্ট পর্যন্ত হালনাগাদ তথ্য অনুযায়ী, এখন পর্যন্ত রাজধানীর মিরপুর, মোহাম্মদপুর, ধানমন্ডি, উত্তরায় আক্রান্তের সংখ্যা হাজারের বেশি। যাত্রাবাড়ী, মুগদা, গুলশান, মহাখালী, বাড্ডা, খিলগাঁও, মগবাজার এলাকায় আক্রান্তের সংখ্যা ছয় শ থেকে হাজারের মধ্যে। এসব এলাকার পাশাপাশি রাজধানীর প্রায় সব এলাকাতেই আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে।

বৃহত্তর মিরপুরে এখন পর্যন্ত ৩ হাজার ৭০ জন মানুষ আক্রান্ত হয়েছেন। এক মাস আগে ২২ জুলাই পর্যন্ত এই অঞ্চলে আক্রান্ত ছিল ২ হাজার ১৫০ জন। অর্থাৎ এই এক মাসে মিরপুরে প্রায় এক হাজার নতুন রোগী শনাক্ত হয়েছেন। ধানমন্ডিতে ২২ জুলাই পর্যন্ত মোট আক্রান্ত ছিলেন ৭৯৫ জন। এখন সেটা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ২১৬ জনে।

লকডাউনের চিত্র

সংক্রমণ ঠেকাতে ২৬ মার্চ থেকে সরকারি ছুটি ঘোষণা করে সারা দেশে কার্যত লকডাউন (অবরুদ্ধ) পরিস্থিতি তৈরি করা হয়েছিল। ৩১ মে থেকে সেই ছুটি তুলে দেওয়া হয়। এরপর সংক্রমণ দ্রুত বাড়তে দেখা যায়। এমন পরিস্থিতিতে সংক্রমণের তীব্রতা অনুপাতে এলাকাভিত্তিক লকডাউনে যাওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছিল। পরীক্ষামূলকভাবে রাজধানীর পূর্ব রাজাবাজার এবং ওয়ারীতে লকডাউন করা হয়। তবে এখন কোনো এলাকায় সংক্রমণ কমানোর দৃশ্যমান উদ্যোগ নেই।

আইইডিসিআরের পরামর্শক মুশতাক হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, রাজধানীতে জনঘনত্ব বেশি। অফিস–আদালত ঢাকায় বেশি। এখন স্বাস্থ্যবিধিও সবখানে মানা হচ্ছে না। ঈদের আগে পরে এখানে নানাভাবে লোকসমাগম ও যাতায়াত বেশি হয়েছে। এসবের একটা প্রভাব রয়েছে। এ ছাড়া রাজধানীতে বড় বড় হাসপাতাল থাকলেও কমিউনিটিভিত্তিক স্বাস্থ্যসেবার ব্যবস্থা একেবারেই নেই। এটি সিটি করপোরেশনের দায়িত্ব। কিন্তু তাদের সেই সম্পদ, জনবল নেই। কমিউনিটিভিত্তিক স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা গেলে বা আক্রান্তদের সবার নিয়মিত ফলোআপ করা গেলে মৃত্যু ও সংক্রমণ আরও কমানো যেত।

দেশে আরও ৪২ জনের মৃত্যু

গতকাল স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, গত রোববার সকাল আটটা থেকে গতকাল সকাল আটটা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় ১৩ হাজার ৩৮২ জনের নমুনা পরীক্ষা করা হয়। তাঁদের মধ্যে ২ হাজার ৪৮৫ জনের দেহে সংক্রমণ শনাক্ত হয়। এই সময়ে করোনায় আক্রান্ত আরও ৪২ জনের মৃত্যু হয়েছে।

দেশে আক্রান্তের সংখ্যা বিবেচনায় মৃত্যুর হার ১ দশমিক ৩৪ শতাংশ। অন্য অনেক দেশের চেয়ে মৃত্যুহার কম। মাঝে দৈনিক মৃত্যু কমতির দিকে থাকলেও আবার সেটা বাড়ছে। প্রায় ১০ দিন ধরে গড়ে প্রতিদিন ৪০ জনের বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে করোনায়।