আদালতের রায়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড পাওয়া আসামির নাম সফিকুল ইসলাম। তাঁর ভাই রফিকুল ইসলামকে তিন বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। দুই ভাইকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দিয়েছেন আদালত। তিন বছর করে সাজা পাওয়া অপর তিনজন হলেন সামছুল ইসলাম, সোমনাথ সাহা ও এমরান হক। এই তিনজন পলাতক। তাঁদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন আদালত।
মামলার রায়ের তথ্য অনুযায়ী, মামলাটি করা হয়েছিল ২০০২ সালের ডিসেম্বরে। ৮ বছর পর ২০১০ সালে অভিযোগ গঠন করা হয়। অভিযোগ গঠনের পর সাক্ষ্য গ্রহণের জন্য ৯০টি তারিখ ধার্য করেও সব সাক্ষীকে হাজির করা যায়নি। অভিযোগপত্রের ১৫ সাক্ষীর মধ্যে ১০ সাক্ষীর সাক্ষ্য যাচাই করা সম্ভব হয়েছে। সাক্ষীদের হাজির করতে আদেশের অনুলিপিসহ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বরাবর চিঠি পাঠানো হলেও রাষ্ট্রপক্ষের পাঁচ সাক্ষীকে আদালতে উপস্থিত করা যায়নি।
আদালত রায়ের পর্যবেক্ষণে বলেন, পাঁচজন সাক্ষী সাক্ষ্য প্রদান না করায় আসামিপক্ষকেই সমর্থন করেছে এমন অনুমান করার কোনো যুক্তিযুক্ত কারণ আছে বলে প্রতীয়মান হয় না। অন্যদিকে তাঁরা সাক্ষ্য না দেওয়ায় মামলাটি প্রমাণিত হয়নি বলেও প্রতীয়মান হয় না। কারণ, সাক্ষীর সংখ্যা কতজন হবে তার কোনো ধরাবাঁধা নিয়ম নেই। আইনের প্রতিষ্ঠিত নীতি হচ্ছে একজন সাক্ষীর সাক্ষ্য বিশ্বাসযোগ্য হলে তার ওপর ভিত্তি করে আসামির সাজা প্রদানে কোনো বাধা নেই।
জব্দ তালিকার তিন সাক্ষী যা বলেছেন
জব্দ তালিকার তিনজন সাক্ষীই বলেছেন, তাঁরা স্বেচ্ছায় জব্দ তালিকায় স্বাক্ষর করেননি। তাঁরা মাদক সম্পর্কে কিছু জানেন না। তাঁদের কাছ থেকে জোর করে স্বাক্ষর নেওয়া হয়েছে। সাক্ষী আবু কাজী তাঁর জবানবন্দিতে বলেন, ঘটনার দিন বিকেলে আবু কাজী তাঁর ভাই কাজী মইনুল ইসলামের গুলশানের বাসায় বেড়াতে যান। তাঁকে ভাইয়ের ফ্ল্যাটে ঢুকতে দেয়নি সাদাপোশাকে থাকা লোকজন। প্রায় এক ঘণ্টা একটি ফ্ল্যাটে তাঁকে বসিয়ে রাখা হয়। তারপর ওপরের ফ্ল্যাট থেকে আসা কয়েকজন তাঁকে একটি সাদা কাগজে স্বাক্ষর করতে বলেন। তিনি স্বাক্ষর করতে অস্বীকৃতি জানালেও তাঁকে ভয় দেখিয়ে স্বাক্ষর নেওয়া হয়।
জব্দ তালিকার সাক্ষী ফাহিম আহসানও একই ধরনের জবানবন্দি দিয়েছেন। তিনি বলেন, ঘটনার দিন পরিচিত রফিকুল নামের একজনকে বিয়ের কার্ড দিতে গিয়েছিলেন। রফিকুলের ফ্ল্যাটে অবস্থান করার সময় ১০ থেকে ১২ জন লোক এসে তাঁর পরিচয় জানতে চান। পরে এক ঘণ্টা বসিয়ে রেখে একটি সাদা কাগজে স্বাক্ষর করতে বলেন। জব্দ তালিকার অন্য আসামি হেমায়েত শেখ জবানবন্দিতে বলেন, ২০ বছর আগের ঘটনা হওয়ায় সাল, তারিখ তাঁর মনে নেই। তিনি ওই এলাকার একটি বাড়িতে রঙের কাজ করছিলেন। ওই সময় দুজন লোক এসে তাঁকে স্বাক্ষর করতে বলায় তিনি স্বাক্ষর করেন।
জব্দ তালিকার তিন সাক্ষীর বিষয়ে আদালত বলেন, এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ্য যে আজকাল স্থানীয় সাক্ষী প্রায় ক্ষেত্রেই আসামির ভয়ে আদালতে হাজির হয়ে আসামির বিরুদ্ধে সাক্ষ্য না দিয়ে আসামির পক্ষে সাক্ষ্য দেন। একইভাবে এই মামলার জব্দ তালিকার তিন সাক্ষীও আদালতে হাজির হয়ে রাষ্ট্রপক্ষের দাবিকে সমর্থন করে সাক্ষ্য দেননি। তবে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের সাক্ষ্য পর্যালোচনায় বিশ্বাসযোগ্য, নির্ভরযোগ্য এবং তাদের বক্তব্য অখণ্ডনীয় বলে আদালতে প্রতীয়মান হয়েছে।
এই মামলার তদন্ত কর্মকর্তা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের পরিদর্শক হেলাল উদ্দিন ভূঁইয়া প্রথম আলোকে বলেন, দীর্ঘদিন পর রায় হলেও তিনি রায় নিয়ে সন্তুষ্ট। হেলাল বলেন, যখন ইয়াবার চালান ধরা পড়েছিল তখন এ সম্পর্কে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কোনো ধারণা ছিল না। সারা দেশে ইয়াবা ছড়িয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা ছিল আসামিদের। সরেজমিন তদন্ত এবং অন্যান্য সাক্ষ্যপ্রমাণের ভিত্তিতেই তিনি অভিযোগপত্র দিয়েছিলেন। আদালতও সেই অনুযায়ী মামলার রায় দিয়েছেন।