মুঠোফোন চুরির অভিযোগে কিশোর কর্মচারী রিয়াদকে (১৬) গুলি করে হত্যার অভিযোগ উঠেছে রাজধানীর মতিঝিলের ঘরোয়া হোটেল অ্যান্ড রেস্টুরেন্টের মালিক আরিফুল ইসলামের বিরুদ্ধে। এই অভিযোগে রিয়াদের বড় ভাই রিপন গতকাল বুধবার ওয়ারী থানায় মামলা করেছেন আরিফুলের বিরুদ্ধে।
রিয়াদের গুলিবিদ্ধ হওয়াকে ছিনতাইয়ের ঘটনা হিসেবে সাজিয়ে গত মঙ্গলবার দিবাগত গভীর রাতে তাকে নেওয়া হয়েছিল ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। পুলিশ এ ঘটনায় ঘরোয়া হোটেলের ব্যবস্থাপক শফিককে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটক করেছে। হোটেলের মালিক পলাতক রয়েছেন। হোটেলটি বন্ধ রাখা হয়েছে।
মামলার অভিযোগ অনুযায়ী, মঙ্গলবার দিবাগত রাতে স্বামীবাগে ওই হোটেলের কর্মচারীদের মেসে নিয়ে রিয়াদকে মারধর ও গুলি করে হত্যা করা হয়। ওই মেসের ক্লোজড সার্কিট ক্যামেরার ফুটেজ জব্দ করেছে পুলিশ।
বিকেলে রিপন ওয়ারী থানায় প্রথম আলেকে বলেন, সাড়ে তিন হাজার টাকা বেতনে তিন বছর ধরে ঘরোয়া হোটেলে কাজ করছিল রিয়াদ। তার গ্রামের বাড়ি চাঁদপুরের হাজীগঞ্জ উপজেলার হারিয়ান সাহেববাড়ী গ্রামে। তিনি বলেন, মঙ্গলবার বিকেলে রিয়াদের মোবাইলে ফোন করা হলে হোটেলের ব্যবস্থাপক শফিক ফোন ধরে বলেন, তিনি শরীয়তপুরে আছেন। পরে রিয়াদের খোঁজে তিনি ওই হোটেলে গিয়ে দোতলার একপ্রান্তে রিয়াদকে হাত বাঁধা অবস্থায় দেখেন। মালিক আরিফ ও অন্য কর্মচারীদের কাছ থেকে মোবাইল চুরির কথা শোনেন তিনি। তিনি মোবাইলের দাম ১৫০০ টাকা পরিশোধ করতে চাইলে তাঁকে হোটেল থেকে বের করে দেওয়া হয়। রাত ১২টার দিকে রিয়াদকে মালিক আরিফুলের পাজেরো গাড়িতে তুলে মতিঝিল থেকে ৭৩ নম্বর স্বামীবাগে কর্মচারী মেসে নিয়ে যাওয়া হয়। গাড়ির পিছু পিছু তিনিও স্বামীবাগে যান। তবে মেসের সামনে হোটেলের কর্মচারী জসিম তাঁকে বের করে দিলে বাসায় চলে যান।
রিপন বলেন, হোটেলের আরেক কর্মচারী মাইনুদ্দীন রাত একটার দিকে তাঁকে ফোন করে রিয়াদের গুলিবিদ্ধ হওয়ার কথা জানান। এরপর তিনি আবার মেসে গিয়ে শোনেন, গুলিবিদ্ধ রিয়াদকে আবারও পাজেরো গাড়িতে তুলে নিয়ে গেছেন আরিফসহ চার যুবক। গতকাল সকালে ঢাকা মেডিকেল কলেজ মর্গে গিয়ে তিনি ভাইয়ের লাশ শনাক্ত করেন।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল পুলিশ ক্যাম্পের পরিদর্শক মোজাম্মেল হক বলেন, মঙ্গলবার দিবাগত রাত দেড়টার দিকে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় রিয়াদকে হাসপাতালে নিয়ে আসেন তাঁর সহকর্মী বলে পরিচয় দেওয়া জসিম। রাত দুইটার দিকে কর্তব্যরত চিকিৎসক রিয়াদকে মৃত ঘোষণা করেন। হাসপাতাল পুলিশকে জসিম বলেছেন, রাত একটার দিকে হোটেলের টাকা নিয়ে সিএনজিচালিত অটোরিকশায় করে শান্তিনগরে মালিকের বাসায় যাচ্ছিল রিয়াদ। শাপলাচত্বর এলাকায় তার অটোরিকশাটি থামার সংকেত দেয় ছিনতাইকারীরা। অটোরিকশা না থামানোয় দুর্বৃত্তরা গুলি ছোড়ে। রিয়াদের মুখমণ্ডলে গুলি লাগে। পরে তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। তবে টাকা খোয়া যায়নি। পরে জসিমকে হাসপাতালে দেখা যায়নি।
ময়নাতদন্ত শেষে গতকাল সন্ধ্যা ছয়টার দিকে রিয়াদের লাশ মর্গ থেকে নিয়ে যান রিপন। ঢাকা মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক বিভাগের ভারপ্রাপ্ত প্রধান আবু সামা বলেন, রিয়াদের ডান চোয়ালে একটি গুলির চিহ্ন ছিল। এ ছাড়া তার শরীরের বিভিন্ন স্থানে আঘাতের চিহ্ন ছিল।
যে মেসকে ঘটনাস্থল বলা হচ্ছে, সেই বাড়ির একাংশ পৈতৃক সূত্রে পেয়েছেন ঘরোয়া হোটেলের মালিক আরিফুল ও তাঁর ভাই। পাঁচ বছর আগে ওই বাড়ি ছেড়ে শান্তিনগরের বাসায় চলে যান আরিফুল। পরে ওই জায়গা ভবন নির্মাণের জন্য একটি আবাসন প্রতিষ্ঠানকে দেওয়া হয়। নির্মাণাধীন আটতলা ভবনের দোতলার একটি অংশ আবাসন প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে ভাড়া নেন ঢাকা মহানগর বঙ্গবন্ধু প্রজন্ম লীগের সভাপতি আবু হানিফ। দোতলার সিঁড়ির ডান পাশে রয়েছে ঘরোয়া হোটেলের কর্মচারীদের মেস। টিন দিয়ে ঘেরা ওই মেসে থাকেন প্রায় ৩০ জন কর্মচারী। নিরাপত্তার কারণে ভবনের দোতলার সামনে দুটি ও সিঁড়ির উল্টো দিকে একটি সিসি ক্যামেরা বসিয়েছেন আবু হানিফ।
আবু হানিফ প্রথম আলোকে বলেন, ‘রাত সোয়া একটার দিকে মেস থেকে হোটেল কর্মচারীদের কথাবার্তা শুনে বাইরে আসি। নিচে এলে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় রিয়াদকে আরিফুলের গাড়িতে করে নিয়ে যাওয়ার কথা হোটেল কর্মচারী মাইনুদ্দীন আমাকে জানান। তখন হোটেলের ব্যবস্থাপক শফিক সেখানে ছিলেন।’ তিনি বলেন, ‘রিয়াদকে গাড়িতে নিয়ে যাওয়ার কিছুক্ষণ পর রাত দেড়টার দিকে শফিকের মোবাইলে ফোন করে আরিফুল আমার সঙ্গে কথা বলেন। তিনি রিয়াদকে একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তির কথা জানান। আরিফুলের কথায় সন্দেহ হলে আমি ওয়ারী থানার উপপরিদর্শক (এসআই) খালেককে ফোন করি। এরপর সিসি ক্যামেরার ফুটেজ দেখি। ফুটেজে রাত ১২টা ৪৪ মিনিটে রিয়াদকে মেসের ভেতর ঢোকাতে এবং গুলিবিদ্ধ অবস্থায় ১টা ৭ মিনিটে বাইরে নিয়ে যাওয়ার দৃশ্য রয়েছে। এ সময় আরিফুলের সঙ্গে একটি পিস্তল ছিল।’ তিনি বলেন, পরে পুলিশ এসে ফুটেজ জব্দ করে ওয়ারী থানায় নিয়ে যায়।
গতকাল মেসে গিয়ে দেখা গেছে, পেছন দিকে জানালার পাশে রক্তের দাগ। সিঁড়ির ওপরও আছে রক্তের দাগ।
ওয়ারী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) তপন চন্দ্র সাহা প্রথম আলোকে বলেন, ঘটনাস্থল থেকে ভিডিও ফুটেজ সংগ্রহ করা হয়েছে। ভিডিও ফুটেজ বিশ্লেষণ করা হচ্ছে। হোটেল মালিক আরিফুল পলাতক রয়েছেন।