ডিভিশন পেয়ে আয়েশে ক্যাসিনো সেলিম

তিন সপ্তাহ ধরে ভিআইপি বন্দী হিসেবে কাশিমপুর কারাগারে সেলিম প্রধান। তিন মামলায় অভিযোগপত্র।

  • অনলাইন ক্যাসিনোর অবৈধ কারবার করে বিপুল অর্থের মালিক হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সেলিম মিয়া বনে যান সেলিম প্রধান

  • ২০১৯ সালে গ্রেপ্তার হওয়ার পর দুই বছর কারাগারে সাধারণ বন্দী হিসেবে ছিলেন তিনি।

সেলিম প্রধান

ডিভিশন পেয়ে আয়েশে আছেন অনলাইন ক্যাসিনোর মূল হোতা সেলিম প্রধান। তিন সপ্তাহ আগে ক্যাটাগরি-২-এর ভিআইপি বন্দী হিসেবে তাঁকে ডিভিশন দেওয়া হয়। ডিভিশন পাওয়ার পর এখন তিনি কাশিমপুর কারাগার-১-এর চতুর্থ তলায় ৪০ নম্বর কক্ষে আছেন। ২০১৯ সালে গ্রেপ্তার হওয়ার পর দুই বছর তিনি কারাগারে সাধারণ বন্দী হিসেবে ছিলেন।

ক্যাসিনোবিরোধী অভিযান চলাকালে ২০১৯ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে থাই এয়ারওয়েজের একটি উড়োজাহাজ থেকে নামিয়ে এনে সেলিম প্রধানকে গ্রেপ্তার করে র‌্যাব। তাঁর বিরুদ্ধে গুলশান থানায় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ, মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনে দুটি ও অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) আরেকটি মামলা করে। সম্প্রতি তিন মামলায় তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়েছে।

কারাবিধি অনুযায়ী রাজনৈতিক ও সামাজিকভাবে মর্যাদাসম্পন্ন ব্যক্তিদের কারাগারে ডিভিশন দেওয়া হয়। কারাবিধির ৬১৭(২)-এ বলা হয়েছে, নাগরিকত্বনির্বিশেষে সামাজিক মর্যাদা, শিক্ষা এবং অভ্যাসের কারণে জীবনমান উন্নত মানের, এমন বন্দীরা ডিভিশন-২ প্রাপ্তির যোগ্য হবেন।

তবে তদন্তসংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ডিভিশন পাওয়া সেলিম প্রধান মাধ্যমিক পাসও করেননি। সেলিমের বাড়ি নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের সাওঘাটে। সেলিম গ্রেপ্তার হওয়ার পর সাওঘাটে সড়ক ও জনপথের জমি দখল করে গড়ে তোলা অনলাইন ক্যাসিনোর একাধিক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান উচ্ছেদ করে স্থানীয় প্রশাসন। অনলাইন ক্যাসিনোর অবৈধ কারবার করে বিপুল অর্থের মালিক হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সেলিম মিয়া বনে যান সেলিম প্রধান। তাঁর নিরাপত্তায় থাকত অস্ত্রধারী সদস্য।

ডিভিশন-২ পাওয়ার পর কারাবিধি অনুসারে পৃথক কক্ষে সেলিম প্রধান খাট, টেবিল, চেয়ার, তোশক, বালিশ, তেল, চিরুনি, আয়না পেয়েছেন। তাঁর কাজকর্ম করে দেওয়ার জন্য রয়েছেন একজন পুরুষ বন্দী। একটি দৈনিক পত্রিকা পাচ্ছেন। দেওয়া হচ্ছে উন্নত মানের খাবার।

কাশিমপুর কারাগার-১-এর কারা তত্ত্বাবধায়ক গিয়াসউদ্দিন শুক্রবার রাতে প্রথম আলোকে বলেন, সেলিম প্রধানের পক্ষ থেকে জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে কারাগারে ডিভিশন চেয়ে আবেদন করা হয়েছিল। ৪ অক্টোবর জেলা ম্যাজিস্ট্রেট জেল কোড অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে আদেশ দেন। আদেশের পর ক্যাটাগরি-২ অনুযায়ী তাঁর ডিভিশন দেওয়া হয়েছে।

২০১৯ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত চলা ক্যাসিনোবিরোধী অভিযানে অনলাইন ক্যাসিনো কারবারি সেলিম প্রধান ছাড়াও তৎকালীন ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের সভাপতি ইসমাইল হোসেন চৌধুরী (সম্রাট), যুবলীগের নেতা বিতর্কিত ঠিকাদার জি কে শামীম, মোহামেডান ক্লাবের তখনকার ডিরেক্টর ইনচার্জ লোকমান হোসেন ভূঁইয়া, কলাবাগান ক্রীড়া চক্রের কর্মকর্তা ও কৃষক লীগের নেতা কাজী শফিকুল আলম ওরফে ফিরোজ, ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া, পুরান ঢাকার আওয়ামী লীগ নেতা এনামুল হক (এনু) ও রুপন ভূঁইয়া, সাবেক ওয়ার্ড কাউন্সিলর ময়নুল হকসহ (মনজু) মোট ১১ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাঁদের মধ্যে লোকমান হোসেন ভূঁইয়া, শফিকুল আলম, ময়নুল হক জামিন পেয়েছেন।

তিন মামলায় অভিযোগপত্র

২০১৯ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর গ্রেপ্তারের পর সেলিম প্রধানের গুলশান ২-এর বাসা-অফিস ও বনানীর অফিসে অভিযান চালান র‍্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত। নগদ ২৯ লাখ ৫ হাজার ৫০০ টাকা, ৭৭ লাখ ৬৩ হাজার টাকার সমপরিমাণ ২৩টি দেশের মুদ্রা, ১২টি পাসপোর্ট, ১৩টি ব্যাংকের ৩২টি চেক, ৪৮ বোতল বিদেশি মদ, ১টি বড় সার্ভার, ৪টি ল্যাপটপ ও ২টি হরিণের চামড়া উদ্ধার করা হয়। সম্প্রতি সেলিম প্রধানের বিরুদ্ধে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ, মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন ও দুদকের করা অবৈধ সম্পদ অর্জনের মামলায় অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছে।

তদন্তসংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, সেলিম প্রধান বাংলাদেশে প্রথম অনলাইন ক্যাসিনো চালু করেন। ঢাকার গুলশান ও বনানীতে সেলিম প্রধান পি ২৪ এবং টি ২১ অনলাইন নামে অনলাইনে ভিডিও গেম খেলার প্ল্যাটফর্ম চালু করেন। পরে ২০১৮ সালের ১৮ ডিসেম্বর সেগুলোকে অনলাইন ক্যাসিনোয় রূপান্তর করেন তিনি। ওই অনলাইন ক্যাসিনোর সদর দপ্তর ছিল ফিলিপাইন। সেখানকার সার্ভার থেকে গুলশানের ক্যাসিনো নিয়ন্ত্রণ করা হতো। ক্যাসিনো খেলার টাকা অনলাইন ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে সেলিম প্রধানের ব্যাংক হিসাবে জমা হতো। অনলাইনে প্রতিটি বিট পাঁচ হাজার টাকা বিক্রি করে টাকা হাতিয়ে নিতেন তিনি। থাইল্যান্ডে তাঁর বাড়িঘর ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে। নিয়মিত ঢাকা-ব্যাংকক আসা-যাওয়া করতেন তিনি।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনের মামলায় অভিযোগপত্রে বলা হয়েছে, সেলিম প্রধান নিজ বাসায় নিয়মিত মদ ও মাদকের আসর বসাতেন। মাদকও বিক্রি করতেন।

মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনের মামলায় পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের দেওয়া অভিযোগপত্রে বলা হয়, অনলাইন ক্যাসিনোর মাধ্যমে অবৈধভাবে উপার্জিত ১৩ কোটি ২৮ লাখ ৮৯ হাজার ১৪৬ টাকা বিদেশে পাচারের উদ্দেশ্যে নিজের কাছে রেখেছিলেন সেলিম প্রধান। গ্রেপ্তারের পর তাঁর কাছ থেকে জব্দ করা ২৮ লাখ ৯৫ হাজার ৫০০ টাকা এবং ৭০ লাখ টাকা মূল্যমানের বিভিন্ন দেশের বিদেশি মুদ্রা রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা দেওয়া হয়েছে।

আর ৫৭ কোটি ৭৯ লাখ টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জন, ২২ কোটি টাকা থাইল্যান্ড ও যুক্তরাষ্ট্রে পাচারের অভিযোগে দুদক সেলিম প্রধানের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেয়।

কারাগারে ক্যাটাগরি-২-এ ডিভিশন কারা পান, জানতে চাইলে কারা অধিদপ্তরের সাবেক উপমহাপরিদর্শক মো. শামসুল হায়দার সিদ্দিকী গতকাল সোমবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘রাজনৈতিক ও সামাজিকভাবে মর্যাদাসম্পন্ন ব্যক্তিদের কারাগারে ডিভিশন দেওয়া হয়। আর নৈতিক স্খলন হওয়া ব্যক্তি ডিভিশন পাবেন না, এটা কারাবিধিতে উল্লেখ আছে। উল্লিখিত ব্যক্তি (সেলিম প্রধান) সামাজিকভাবে মর্যাদাসম্পন্ন নন। তাই এই ব্যক্তিকে ডিভিশন-২ দেওয়া সমীচীন হয়নি বলে মনে করি।’