ধরাছোঁয়ার বাইরে মূল হোতা মেহেদী

ব্রুনেইয়ে নিজের বিলাসবহুল গাড়ির সামনে মানব পাচারের হোতা মেহেদি হাসান
ছবি: সিআইডি

ব্রুনেইয়ে মানব পাচার চক্রের প্রধান ব্যক্তি মেহেদী হাসান ওরফে বিজনকে (২৮) এখনো গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ। তাঁর কয়েকজন সহযোগী ধরা পড়লেও পুলিশ বলছে, মেহেদী হাসান ও তাঁর অন্য সহযোগীরা দেশে গা ঢাকা দিয়ে আছেন।
মেহেদী ব্রুনেইয়ের এক নারীর সঙ্গে যৌথভাবে, কখনো এককভাবে একাধিক নামসর্বস্ব প্রতিষ্ঠান খুলে বাংলাদেশ থেকে প্রায় ১০ হাজার মানুষ পাচার করেন। সর্বশেষ ৪ শতাধিক ব্যক্তির কাছ থেকে ৩৩ কোটি টাকা নিয়ে মাত্র ৬০ জনকে ব্রুনেইয়ে নিয়ে যায় মেহেদী। কিন্তু তাঁদের কোনো কাজ দেওয়া হয়নি। ব্রুনেইয়ের রাস্তায় তাঁদের দিন কাটতে থাকে। পরে করোনা মহামারির সময় দেশে নিজ পরিবারের আর্থিক সহযোগিতায় গত জানুয়ারিতে দেশে ফিরে আসেন। দেশে ফিরে তাঁরা ব্রুনেইয়ে অবস্থানরত মেহেদী হাসানসহ তাঁর সহযোগীদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন থানায় মানব পাচার ও প্রতারণার আইনে অন্তত ২০টি মামলা করেন।

গত বুধবার র‍্যাব-৩-এর একটি দল মেহেদীর সহযোগী শেখ আমিনুর রহমান হিমু, তাঁর দুই সহযোগী নুর আমিন ও বাবুল রহমানকে অস্ত্রসহ কাফরুল এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করে। এ নিয়ে এই চক্রের ৯ জনকে গ্রেপ্তার করা হলো।

প্রতারণার অভিযোগে মেহেদী হাসান ও তাঁর সাত সহযোগীর পাসপোর্ট বাতিল করে ব্রুনেইয়ের সরকার তাঁদের কারাগারে পাঠিয়ে দেয়। পরে বাংলাদেশে করোনা সংক্রমণের আগে গত ফেব্রুয়ারিতে মেহেদী হাসানসহ পাঁচজন দেশে ফেরত আসেন। দুজন মালয়েশিয়ায় পাড়ি জমান। এখন পর্যন্ত এই চক্রের ছয়জন ধরা পড়েছে। মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা কাফরুল থানার উপপরিদর্শক (এসআই) আবদুর রহমান গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, মেহেদীসহ পলাতক বাকি আসামিদের গ্রেপ্তারে চেষ্টা চলছে।

মেহেদী হাসান ৯ বছর আগে শ্রমিক ভিসায় ব্রুনেইয়ে যান। মেহেদী হাসানের বাড়ি মেহেরপুরের মুজিবনগর উপজেলার যতারপুরে। স্থানীয় বাসিন্দাদের অনেকে তাঁকে চেনেন না। মেহেদী হাসানের বাবা মোস্তাকিন হাসান পেশায় কৃষক। তাঁর ১০-১১ বিঘা জমি আছে। তিন ভাইয়ের মধ্যে সবার বড় মেহেদী। ছোট দুই ভাই বাড়িতে কৃষিকাজ করেন। এক বছর আগে মেহেদী হাসান গ্রামের বাড়িতে একতলা পাকা বাড়ি বানিয়েছেন।

যতারপুর গ্রামের বাসিন্দা খাদেমুল ইসলাম বলেন, ‘মেহেদী হাসান এলাকায় তেমন আসা-যাওয়া করেন না। বিদেশে থাকেন বলে জানি। তবে দুই মাস আগে তাঁকে একবার এলাকায় দেখা গেছে।’

মামলার ছায়া তদন্তের সঙ্গে যুক্ত র‍্যাব-৩-এর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার বীণা রানী দাস প্রথম আলোকে বলেন, মেহেদী হাসান বা তাঁর সহযোগীদের নামে বাংলাদেশে কোনো রিক্রুটিং লাইসেন্স নেই। তাঁরা রাজধানীর নয়াপল্টনের হাইওয়ে ইন্টারন্যাশনাল ও কিশোরগঞ্জের নজরুল ইন্টারন্যাশনালে সার্ভিসের মাধ্যমে ব্রুনেইয়ে লোক পাঠিয়ে প্রতারণা করতেন বা পাঠানোর কথা বলে টাকা নিতেন। মানব পাচারে সহায়তা করার অভিযোগে হাইওয়ে ইন্টারন্যাশনালের মালিক মোহাম্মদ আবুল কালাম এবং নজরুল ইন্টারন্যাশনালের মালিক নজরুল ইসলামকেও খুঁজছে র‍্যাব।
ভুক্তভোগীদের বরাত দিয়ে সিআইডির একাধিক কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, ব্রুনেইয়ে থাকার সময় মেহেদী বিলাসবহুল জীবন যাপন করতেন। তিনি সেখানে বুলেটপ্রুফ হামার এইচ-২ গাড়ি চালাতেন। সেই গাড়ির নম্বরও ছিল মেহেদীর সেখানকার মুঠোফোন নম্বরের সঙ্গে মেলানো।

পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) বিশেষ সুপার সামসুন নাহার বলেন, মেহেদী হাসানের কর্মকাণ্ড নিয়ে ব্রুনেইয়ে বাংলাদেশের হাইকমিশনার গত ৩ জানুয়ারি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে একটি প্রতিবেদন দেন। সেটি আসে সিআইডির হাতে। পরে ভুক্তভোগীদের অভিযোগের ভিত্তিতে মেহেদীর সহযোগীদের গ্রেপ্তার করা হয়। তিনি বলেন, গ্রেপ্তারের খবর শুনে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে শত শত মানুষ আসতে থাকেন। সবারই অভিযোগ, কাজ দেওয়ার নামে বিদেশে নিয়ে প্রতারণা করেছে এই চক্র।