প্রকল্পের টাকায় গাড়িবিলাস

প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হওয়ার ১০ মাস পর প্রকল্প তদারকির নামে তিনটি বিলাসবহুল গাড়ি কিনেছে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি)। সব নিয়মকানুন ভেঙে এসব গাড়ি এখন ব্যবহার করছেন প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা এইচ টি ইমাম, স্থানীয় সরকার মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম ও প্রতিমন্ত্রী মসিউর রহমান রাঙ্গা।
গাড়ি তিনটি কেনাও হয়েছে, আবার ২০১২ সালে প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়ন প্রকল্প থেকে নেওয়া পেশাদারি ফির টাকা অপব্যবহার করে। এর একেকটির দাম পৌনে চার কোটি টাকা। কেবল গাড়ি কেনাই নয়, সরকারের প্রভাবশালী ব্যক্তিদের গাড়ির জ্বালানি খরচও দেওয়া হয়েছে কোটি কোটি টাকা পেশাদারি ফি অপচয় করে।
বিভিন্ন সরকারি প্রকল্পের ভৌত অবকাঠামো নির্মাণের জন্য বহু বছর ধরে নির্দিষ্ট হারে ‘সার্ভিস চার্জ’ নিচ্ছে এলজিইডি, তার নাম পেশাদারি ফি। ১৯৯৮ সালের ২০ জুলাই অনুষ্ঠিত একনেকের সভার সিদ্ধান্ত অনুসারে এলজিইডি তাদের বাস্তবায়ন করা প্রকল্পগুলো থেকে ২ শতাংশ হারে পেশাদারি ফি নেয়। একনেকের সিদ্ধান্ত ছিল, প্রকল্পের সুষ্ঠু বাস্তবায়ন ও তদারকির স্বার্থে আপৎকালীন (কনটিনজেন্সি) প্রয়োজনে এ টাকা খরচ করা যাবে। যন্ত্রপাতি কেনাকাটা বা বেতন-ভাতায় এ টাকা খরচ করতে গেলে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন লাগবে এবং প্রকল্প প্রস্তাব বা ডিপিপিতে উল্লেখ থাকতে হবে। কিন্তু এলজিইডি কোনো অনুমোদন না নিয়েই প্রভাবশালী ব্যক্তিদের তুষ্ট করতে এ টাকা ব্যবহার করেছে।
মহা হিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রকের (সিএজি) কার্যালয়ের সাম্প্রতিক এক নিরীক্ষায় এলজিইডির এসব অনিয়ম ধরা পড়েছে। নিরীক্ষায় দেখা গেছে, গাড়ি কেনা ছাড়াও পেশাদারি ফির টাকা থেকে প্রকল্পবহির্ভূত শতাধিক গাড়ির জ্বালানির দাম ও গাড়িচালকের বেতন-ভাতাও মিটিয়েছে এলজিইডি। এসব গাড়ি ব্যবহার করেছেন মন্ত্রী, সচিব, প্রকৌশলীসহ নানা স্তরের সরকারি কর্মকর্তা। এমনকি জ্বালানির দাম পরিশোধের জন্য অনৈতিকভাবে গাড়িচালকদের ব্যাংক হিসাবে এক কোটি টাকারও বেশি পাঠানো হয়েছে।
প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের দ্বিতীয় ও তৃতীয় প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়ন প্রকল্প (পিইডিপি-২ ও ৩) বাস্তবায়নের জন্য ২০০৫ থেকে ২০১৩ সালের জুন পর্যন্ত প্রায় ৮৫ কোটি ৬০ লাখ টাকা পেশাদারি ফি নিয়েছে এলজিইডি। এর মধ্যে প্রায় ২২ কোটি টাকা খরচ হয়েছে গাড়িবিলাসে। এলজিইডির পেশাদারি ফি ব্যবহারের ওপর গত মে থেকে জুলাই পর্যন্ত এ নিরীক্ষা করে সিএজির বৈদেশিক সাহায্যপুষ্ট প্রকল্প অডিট অধিদপ্তর (ফাপাড)।
গত ২৭ নভেম্বর এলজিইডির প্রধান কার্যালয়ে গিয়ে এসব বিষয় নিয়ে প্রধান প্রকৌশলী ওয়াহিদুর রহমানের কাছে জানতে চাওয়া হয়। দুই দিন আগে সাক্ষাতের সময় নিয়ে যাওয়া হলেও তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘নিরীক্ষা আপত্তিগুলো আমার ভালো মনে নেই।’
জানতে চাইলে সাবেক মহা হিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক এম হাফিজউদ্দিন খান প্রথম আলোকে বলেন, নিরীক্ষা অধিদপ্তরের তোলা প্রতিটি আপত্তিই সঠিক। পেশাদারি ফি ব্যবহারে এলজিইডি যা করেছে, তার সবই আর্থিক শৃঙ্খলাবহির্ভূত
প্রকল্প শেষ হওয়ার পর বিলাসবহুল গাড়ি: নিরীক্ষা প্রতিবেদন অনুসারে, ২০১১ সালের ৩০ জুন পিইডিপি-২-এর কাজ শেষ হয়। এর প্রায় ১০ মাস পর ২০১২ সালের এপ্রিলে ওই প্রকল্প থেকে পাওয়া পেশাদারি ফির ১১ কোটি ৬০ লাখ টাকা খরচ করে তিনটি গাড়ি (টয়োটা প্রাডো) কেনে এলজিইডি। এই গাড়ি তিনটি কেনার বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে নিরীক্ষা অধিদপ্তর বলছে, পেশাদারি ফির টাকায় গাড়ি কিনতে গেলে ডিপিপিতে উল্লেখ করে তা অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে অনুমোদন নিতে হবে।
এ আপত্তির জবাবে এলজিইডি বলেছে, সারা দেশে প্রকল্পের সুষ্ঠু বাস্তবায়ন ও নিবিড় তদারকির স্বার্থে ২০১১ সালের ৯ আগস্ট ১০টি তদারকি গাড়ি ও তিনটি জিপ কেনার অনুমোদন দেয় স্থানীয় সরকার বিভাগ। এই জবাব সন্তোষজনক নয় উল্লেখ করে নিরীক্ষা অধিদপ্তর বলছে, প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার পর তদারকির জন্য গাড়ি কেনা যায় না। এ ধরনের বিলাসবহুল গাড়ি মাঠপর্যায়ে যথেচ্ছ ব্যবহারের উপযুক্ত নয়। আর এই অর্থে অন্তত ১০টি গাড়ি কেনা যেত। অপ্রয়োজনীয় এসব গাড়ি প্রকল্পের কাজে নয়, বরং সচিবালয়ে ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে ব্যবহৃত হয়েছে।
এলজিইডির একাধিক নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়, কেনার পর থেকে একটি গাড়ি ব্যবহার করতেন সাবেক স্থানীয় সরকার প্রতিমন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানক। তবে এই গাড়ি বর্তমান প্রতিমন্ত্রী মসিউর রহমান ব্যবহার করছেন। বাকি গাড়ি দুটি ব্যবহার করছেন এইচ টি ইমাম ও সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম।
মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও উপমন্ত্রীদের সুযোগসুবিধা-সংক্রান্ত আইনে বলা আছে, তাঁরা সরকারি খরচে একটি গাড়ি পাবেন। আর জরুরি দাপ্তরিক কাজের জন্য সংশ্লিষ্ট দপ্তর থেকে একটি অতিরিক্ত জিপ পাবেন, বিশেষ করে ঢাকার বাইরে যাওয়ার জন্য। প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টারাও মন্ত্রীর সুযোগ-সুবিধা ভোগ করবেন। কিন্তু নিজেদের সরকারি এবং দাপ্তরিক গাড়ি থাকার পরও তাঁরা এলজিইডির গাড়ি ব্যবহার করছেন।
এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে এইচ টি ইমামের মুঠোফোনে একাধিকবার চেষ্টা ও খুদে বার্তা পাঠানো হয়। কিন্তু তিনি কোনো সাড়া দেননি। মসিউর রহমান বিদেশে আছেন।
গাড়িচালকদের ব্যাংক হিসাবে কোটি টাকা: নিরীক্ষা প্রতিবেদন অনুসারে, প্রকল্পের পেশাদারি ফি থেকে প্রকল্পের বিভিন্ন গাড়ির চালকদের ব্যাংক হিসাবে ২০০৮ থেকে ২০১৩ সালের জুন পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে মোট এক কোটি সাত লাখ ৭২ হাজার টাকা পাঠানো হয়েছে। এলজিইডি বলছে, গাড়ির রক্ষণাবেক্ষণ ও জ্বালানি খরচ পরিশোধের জন্য এই টাকা পাঠানো হয়েছে। কিন্তু নিরীক্ষা অধিদপ্তর বলছে, জ্বালানির দাম পরিশোধের জন্য গাড়িচালকদের টাকা দেওয়া গুরুতর অনিয়ম। সব সরকারি দপ্তর জ্বালানি স্টেশনের সঙ্গে চুক্তি করে বাকিতে জ্বালানি কেনে, পরে ওই স্টেশনকে মূল্য পরিশোধ করে। গাড়ি মেরামত বা রক্ষণাবেক্ষণের জন্য ওয়ার্কশপগুলোর সঙ্গে একই রকম চুক্তি করা হয়।
অননুমোদিত গাড়ির জন্য সোয়া নয় কোটি টাকা: নিরীক্ষা প্রতিবেদন অনুযায়ী, পিইডিপি-২ ও পিইডিইপি-৩ থেকে পাওয়া পেশাদারি ফির প্রায় সোয়া নয় কোটি টাকা অনুমোদনহীন ও প্রকল্পবহির্ভূত গাড়ির পেছনেও খরচ করেছে এলজিইডি। এর মধ্যে জ্বালানি বাবদ সাড়ে চার কোটি, রক্ষণাবেক্ষণ ও মেরামতের জন্য সাড়ে তিন কোটি এবং গাড়িচালকদের বেতন-ভাতায় সোয়া এক কোটি টাকা খরচ হয়েছে। ২০০৫ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত এ টাকা খরচ করা হয়।
নিরীক্ষা প্রতিবেদনে এক অর্থবছরের উদাহরণ দেওয়া হয়েছে। যেমন, ২০১২-১৩ সময়ে পিইডিইপি-৩ প্রকল্পের বাইরের বিভিন্ন দপ্তরের পদস্থ কর্মকর্তাদের ব্যবহার করা গাড়ির জ্বালানি বাবদ প্রায় ৯৫ লাখ টাকা পেশাদারি ফি থেকে পরিশোধ করে দিয়েছে এলজিইডি। প্রতিবেদনে এ ধরনের ৪২ জনের নাম রয়েছে। তাঁদের মধ্যে সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের জ্বালানি বিল ছিল পাঁচ লাখ সাত হাজার টাকা, মাসে ৪২ হাজার টাকা করে। এর পরই রয়েছেন এলজিইডির অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী (রক্ষণাবেক্ষণ) শ্যামা প্রসাদ অধিকারী, তাঁর ব্যবহৃত গাড়ির জ্বালানি বিল ছিল পাঁচ লাখ পাঁচ হাজার টাকা। চার লাখ টাকার ওপরে জ্বালানি বিল মেটানো হয়েছে এলজিআরডি মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব শাহ কামাল, এলজিইডির অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী (নগর ব্যবস্থাপনা) মো. নুরুল্লাহ এবং তদারকি ও মূল্যায়ন বিভাগের প্রধান আনোয়ার হোসেনকে।
মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব কে এইচ মাসুদ সিদ্দিকীর জ্বালানি বিল ছিল পৌনে চার লাখ টাকা। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সাবেক মন্ত্রী আফছারুল আমীন ও সাবেক সচিব নিয়াজউদ্দিনকে যথাক্রমে ৮৫ হাজার ও দুই লাখ টাকার জ্বালানি বিল দেওয়া হয়েছে। পেশাদারি ফি থেকে জ্বালানি খরচ পেতে বাদ যাননি স্থানীয় সরকার বিভাগ ও এলজিইডির বিভিন্ন স্তর ও প্রকল্পের অন্য কর্মকর্তারাও।
নিরীক্ষা প্রতিবেদনে আরও দেখা যায়, একই অর্থবছরে পিইডিইপি-৩ প্রকল্পের বাইরের ৫৭ জন সরকারি কর্মকর্তার ব্যবহার করা গাড়ির চালককে এক কোটি আট লাখ টাকা ওভারটাইম ও বেতন-ভাতা দেওয়া হয়েছে পেশাদারি ফি থেকে। তাঁদের মধ্যে স্থানীয় সরকার বিভাগের নানা স্তরের কর্মকর্তা ও বিভিন্ন প্রকল্পের পরিচালক ছাড়াও আছেন পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, এলজিইডির প্রকৌশলী প্রমুখ।
এ আপত্তির জবাবে এলজিইডি বলছে, প্রকল্পের সুষ্ঠু বাস্তবায়নের জন্য পেশাদারি ফি থেকে এ টাকা খরচ করা হয়েছে। নিরীক্ষা অধিদপ্তর বলছে, যাঁদের সঙ্গে প্রকল্পের ন্যূনতম সংযোগ নেই, তাঁদের ব্যবহৃত গাড়ির জ্বালানি খরচ মিটিয়ে স্পষ্টতই পেশাদারি ফির অপব্যবহার করা হয়েছে।
গত ২৬ অক্টোবর এই নিরীক্ষা প্রতিবেদনটি স্থানীয় সরকার বিভাগের সচিবের কাছে পাঠানো হয়। এ বিষয়ে স্থানীয় সরকার সচিব মনজুর হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, তিনি এখনো প্রতিবেদনটি দেখেননি।
সাবেক সিএজি ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এম হাফিজউদ্দিন খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘এলজিইডির বিভিন্ন প্রকল্পের গাড়ি সরকারের প্রভাবশালী মন্ত্রী-আমলাদের নিয়মনীতি ভেঙে ব্যবহার করতে দেওয়া হচ্ছে—এ অভিযোগ নতুন নয়। আমি যখন অডিটর জেনারেল ছিলাম, তখনো এমন অভিযোগ ছিল। কিন্তু এটা বন্ধ হয়নি, চলছেই। কোনোভাবেই এলজিইডি ঠিক হচ্ছে না।’