রাজধানীর মহাখালীতে ফিজিওথেরাপি কলেজের জন্য বরাদ্দ সোয়া পাঁচ একর জমিতে গড়ে ওঠা অবৈধ বস্তি উচ্ছেদ হচ্ছে না। ফলে সাত বছর ধরে কলেজের ভবন নির্মাণকাজ আটকে আছে।
বস্তিবাসীর পক্ষ থেকে করা রিট আবেদনের নিষ্পত্তি করে হাইকোর্ট ২৮ মাস আগে সেখানে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে ফিজিওথেরাপি কলেজ নির্মাণে ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু অধিদপ্তর বস্তি উচ্ছেদে কোনো উদ্যোগই নেয়নি। শ্রমিক লীগের নেতা নামধারী, সরকারি কর্মচারী ও বিভিন্ন ব্যক্তি এসব বস্তিঘর তৈরি করে ভাড়া দিয়েছেন। বস্তিকে কেন্দ্র করে চলছে মাদকের ব্যবসা ও ছিনতাই। আর নিজস্ব কলেজ ভবনের অভাবে শিক্ষার্থীদের জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠান (পঙ্গু হাসপাতাল) এবং নগরীর বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ক্লাস করে দুর্ভোগে পড়তে হচ্ছে। এতে করে তাঁদের শিক্ষা কার্যক্রমেও ঘটছে ব্যাঘাত।
বস্তিবাসীর পক্ষে হুমায়ুন কবির নামের এক ব্যক্তির করা রিটের নিষ্পত্তি করে ২০১৩ সালের ১৭ জুন রায় দেন সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি নাঈমা হায়দার ও বিচারপতি জাফর আহমদ। রায়ে বলা হয়, সরকারের অধিগ্রহণ করা জমিতে আবেদনকারীর থাকার আইনগত অধিকার নেই। রায়ে আবেদনকারীসহ অবৈধ দখলদারদের দুই মাসের সময় দিয়ে ফিজিওথেরাপি কলেজের জন্য জমি ছেড়ে দিতে বলা হয়। পাশাপাশি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরসহ সংশ্লিষ্টদের কলেজ ভবন নির্মাণে ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দেওয়া হয়।
এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক দীন মোহাম্মদ নুরুল হক প্রথম আলোকে বলেন, তিনি এখনো হাইকোর্টের আদেশ পাননি।
ফিজিওথেরাপির বিভিন্ন বর্ষে অধ্যায়নরত শিক্ষার্থীরা জানান, কলেজ ভবন নির্মাণের দাবিতে তাঁরা কয়েক বছরে রাজধানীতে চার দফায় ২৪ দিন আমরণ অনশনসহ অবস্থান ধর্মঘট, বিক্ষোভ মিছিল, মানববন্ধন, সংবাদ সম্মেলন ও বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করেছেন। এত কিছুর পর ২০০৮ সালের সেপ্টেম্বরে মহাখালীর আইপিএইচ (জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট) স্কুল অ্যান্ড কলেজের সীমানাপ্রাচীরের দক্ষিণ পাশে ফিজিওথেরাপি কলেজের জন্য জমি বরাদ্দ দেওয়া হয়। ২০১০ সালের ১০ সেপ্টেম্বর ওই জায়গায় কলেজ ভবনের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন তৎকালীন স্বাস্থ্যমন্ত্রী রুহুল হক। সীমানাপ্রাচীর নির্মাণের পর ভবন নির্মাণের কাজও শুরু হয়েছিল। কিন্তু স্থানীয় সন্ত্রাসীদের বাধায় নির্মাণকাজ বন্ধ হয়ে যায়। এরপর পর ওই খালি জমিতে পর্যায়ক্রমে দুই হাজারের বেশি বস্তিঘর গড়ে ওঠে।
আইপিএইচ বস্তি হিসেবে পরিচিত ওই বস্তিতে গিয়ে দেখা যায়, ভিত্তিপ্রস্তর ও সীমানাপ্রাচীরের কোনো চিহ্নই নেই। আইপিএইচ স্কুলের সীমানাপ্রাচীরের উত্তর পাশে টিনের চাল দিয়ে তৈরি অসংখ্য ঘর। সামনের সারির ঘরগুলোতে রয়েছে মুদিখানা, সেলুন, রেস্তোরাঁ ও ওষুদের দোকান। বস্তিতে আছে অবৈধ বিদ্যুৎ, পানি ও গ্যাসের সংযোগ। একজন বস্তিবাসী জানান, তিনি ছোট দুটি ঘরের জন্য মাসে চার হাজার টাকা ভাড়া দেন। বড় আয়তনের একটি ঘরের ভাড়া মাসে তিন হাজার টাকা। বস্তিতে মাদকের ব্যবসাও চলে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ১০ জন বস্তিবাসী জানান, শ্রমিক লীগের স্থানীয় নেতা পরিচয় দেওয়া দিদার, শাহ আলম, নাসির ওরফে হাতকাটা নাসির ও তাঁদের সহযোগী আজিজ, আবদুল জলিল, শামীম, সুমন, সোবহান এবং ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব প্রিভেন্টিভ অ্যান্ড সোশ্যাল মেডিসিন (নিপসম) ও আইপিএইচের কতিপয় কর্মচারী এসব ঘরের মালিক।
বনানী থানা সূত্র জানা গেছে, সন্ত্রাসী নাসির তাঁর সহযোগী শামীম হত্যা মামলার আসামি। বনানী থানায় জলিলের বিরুদ্ধে সাতটি মামলা আছে। দিদার চাঁদাবাজ হিসেবে পরিচিত।
আবদুল জলিল নিজেকে আইপিএইচ মসজিদপাড়া ইউনিট শ্রমিক লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক দাবি করে বলেন, ‘আইপিএইচ বস্তিতে আমার কয়েকটা ঘর আছে। আমার অপরাধ একটাই—আমি বস্তির ঘরে বিদ্যুৎ-সংযোগ দিই এবং এসব সংযোগ থেকে নিজের ব্যাটারিচালিত অটোরিকশায় চার্জ দিই।’ তিনি জানান, র্যা বের ক্রসফায়ারে তিনি একটি পা হারিয়েছেন, গুলিবিদ্ধ অন্য পা’টাও অকেজো। তাঁর বিরুদ্ধে র্যা বের দেওয়া সাতটি মামলা আছে। তাঁর পাশাপাশি দিদার, নাসির, আজিজ ও শামীমও বস্তি নিয়ন্ত্রণ করেন। অন্যদের ফোনে পাওয়া যায়নি। এ ছাড়া নিপসম এবং আইপিএইচের যেসব কর্মচারীর বিরুদ্ধে বস্তিতে ঘর তোলার অভিযোগ রয়েছে ওই দুটি প্রতিষ্ঠানে গিয়ে তাঁদের পাওয়া যায়নি।
বনানী থানার ওসি সালাহউদ্দিন খান বলেন, আইপিএইচ বস্তিতে অভিযান চলছে। এর আগে মাদক রাখার দায়ে ভ্রাম্যমাণ আদালত তিন নারীকে কারাদণ্ড দিয়েছিলেন। বস্তিটি সন্ত্রাসীদের আখড়া। ওই জমিতে কলেজ গড়ে উঠলে বস্তি উঠে যাবে এবং এলাকাও মাদকমুক্ত হবে।