বাবার হত্যা দেখে ফেলায় মেয়েকেও খুন

জামিল শেখ ও নুসরাত আক্তার
জামিল শেখ ও নুসরাত আক্তার

বিবাহবহির্ভূত সম্পর্কের জের ধরে রাজধানীর বাড্ডায় খুন করা হয় গাড়িচালক জামিল শেখকে। আর সেটা দেখে ফেলায় নয় বছরের মেয়েটিকেও শ্বাসরোধে হত্যা করা হয়। গ্রেপ্তারের পর পুলিশকে এমনই তথ্য দিয়েছেন বাবা-মেয়ের হত্যার প্রধান আসামি শাহীন মল্লিক।

শাহীন মল্লিক (২৩) ও তাঁর স্ত্রী মাসুমাকে বৃহস্পতিবার রাতে খুলনার লবণচরা থানার মোহাম্মদনগর এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। এই দম্পতি জামিলের ভাড়া করা বাসার একটি কক্ষে (সাবলেট) থাকতেন।

গাড়িচালক জামিল শেখ ও তাঁর তৃতীয় শ্রেণিপড়ুয়া মেয়ে নুসরাত আক্তার খুন হয় বুধবার রাতে। বৃহস্পতিবার সকালে তাদের লাশ উদ্ধার করা হয়। তখন শাহীন মল্লিক ও তাঁর স্ত্রী মাসুমা পলাতক ছিলেন। ঘটনার পরপরই পুলিশ জামিল শেখের স্ত্রী আর্জিনাকে গ্রেপ্তার করে। জামিলের ভাই শামীম শেখ বৃহস্পতিবার শাহীন মল্লিক ও আর্জিনাকে আসামি করে বাড্ডা থানায় মামলা করেন। আর্জিনার দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে বৃহস্পতিবার রাতেই বাড্ডা থানা-পুলিশের পাঁচ সদস্যের একটি দল খুলনায় অভিযানে বের হয়।

খুলনা মহানগরের লবণচরা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শফিকুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, শাহীন ও তাঁর স্ত্রীকে নিয়ে খুলনায় তাঁর ভাইয়ের বাসায় এসে উঠেছিলেন। লবণচরা থানা-পুলিশের সহযোগিতায় বাড্ডা থানা-পুলিশ সেখান থেকে তাঁদের গ্রেপ্তার করে।

পুলিশের সঙ্গে খুলনার অভিযানে গিয়েছিলেন জামিল শেখের বড় ভাই দুলাল শেখ। গ্রেপ্তারের পর তাঁর সামনেই প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। দুলাল শেখ প্রথম আলোকেবলেন, রাত সাড়ে তিনটায় তাঁদের গ্রেপ্তার করা হয়। গ্রেপ্তারের পর পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে শাহীন জানিয়েছেন, জামিলের স্ত্রী আর্জিনার সঙ্গে সাত থেকে আট মাস ধরে তাঁর প্রেমের সম্পর্ক। জামিল এর আগে যে বাসায় থাকতেন, সেই বাসারই তিনতলায় থাকতেন রংমিস্ত্রি শাহীন। জামিল বাড্ডায় নতুন বাসায় ওঠার পর পরিকল্পিতভাবেই তাঁদের বাসায় একটি কক্ষ ভাড়া (সাবলেট) নিয়ে ওঠেন শাহীন।

দুলাল শেখ বলেন, শাহীন জিজ্ঞাসাবাদে পুলিশকে বলেছেন, তাঁর পরিকল্পনা ছিল জামিলকে খুন করার পর আর্জিনাকে সঙ্গে নিয়ে পালিয়ে যাবেন। পরিকল্পনার অংশ হিসেবে আর্জিনা ঘরের দরজা খোলা রাখেন। রাত সাড়ে ১১টা থেকে ১২টার দিকে শাহীন ঘরে ঢোকেন। এরপর তিনি একটি কাঠের টুকরা দিয়ে ঘুমন্ত জামিলের মাথায় আঘাত করে তাঁকে হত্যা করেন। এ সময় পাশেই ঘুমিয়ে থাকা তার মেয়ে নুসরাত জেগে ওঠে। তখন তাকে শ্বাসরোধে হত্যা করেন শাহীন। মেয়েকে হত্যা না করতে শাহীনকে অনুরোধ করেছিলেন আর্জিনা। কিন্তু শাহীন সেই অনুরোধ রাখেননি। এ জন্য তিনি আর শাহীনের সঙ্গে পালিয়ে যেতে রাজি হননি। জিজ্ঞাসাবাদে শাহীন আরও জানান, আর্জিনার সঙ্গে সম্পর্কের একটি ভিডিও চিত্র তাঁর কাছে ছিল। সেটি দেখিয়ে তিনি আর্জিনাকে ভয় দেখাতেন।

শাহীনের কাছে পাওয়া এসব তথ্যের বিষয়ে পুলিশ গতকাল পর্যন্ত কিছু প্রকাশ করেনি। এ বিষয়ে বাড্ডা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) কাজী ওয়াজেদ আলী প্রথম আলোকে বলেন, আসামিদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাঁদের জিজ্ঞাসাবাদ চলছে। আজ শনিবার বিস্তারিত জানানো হবে।

এদিকে গতকাল শুক্রবার সকালে গোপালগঞ্জের বনগ্রাম পূর্বপাড়ায় পারিবারিক কবরস্থানে জামাল শেখ ও তাঁর মেয়েকে দাফন করা হয়েছে। জামালের পাঁচ বছরের ছোট ছেলে আলভী থানা-হাজতে থাকা তার মায়ের সঙ্গেই রয়েছে বলে জানিয়েছেন স্বজনেরা।

মা-ছেলে হত্যায় রিমান্ডে তৃতীয় স্ত্রীসহ ব্যবসায়ী করিম

এদিকে রাজধানীর কাকরাইলে মা ও ছেলে হত্যার ঘটনায় ব্যবসায়ী আবদুল করিম ও তাঁর তৃতীয় স্ত্রী শারমিন আক্তারকে গতকাল ছয় দিনের রিমান্ডে নিয়েছে পুলিশ।

এ ঘটনায় রমনা থানায় মামলা করেন নিহত শামসুন্নাহারের ভাই আশরাফ আলী। এজাহারে বলা হয়, শামসুন্নাহার তাঁর স্বামী আবদুল করিমের বিভিন্ন অনৈতিক কর্মকাণ্ডে বাধা দিচ্ছিলেন। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে আবদুল করিম তাঁর ওপর শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন চালাচ্ছিলেন, হত্যার হুমকি দিচ্ছিলেন। আবদুল করিম, তাঁর তৃতীয় স্ত্রী শারমিন আক্তার ও শারমিনের ভাই আল আমিন অজ্ঞাতনামা খুনিদের দিয়ে শামসুন্নাহার ও তাঁর কলেজপড়ুয়া ছেলেকে হত্যা করেছেন।

মামলার তদন্ত-তদারক কর্মকর্তা পুলিশের রমনা বিভাগের ভারপ্রাপ্ত উপকমিশনার নাবিদ কামাল শৈবাল গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, শামসুন্নাহার অনেক সম্পত্তির মালিক ছিলেন। সেই সম্পত্তি ফেরত নিতে না পেরে শারমিন শামসুন্নাহারের ওপর ক্ষিপ্ত ছিলেন আবদুল করিম ও তাঁর তৃতীয় স্ত্রী। শারমিনের ভাই আল আমিনকে গ্রেপ্তার করা গেলে হত্যায় কারা অংশ নিয়েছিল সে বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া যাবে। তাঁকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।

নাবিদ কামাল শৈবাল বলেন, শামসুন্নাহারকে খুন করাই লক্ষ্য ছিল হামলাকারীদের। কিন্তু শামসুন্নাহারের ছেলে সাজ্জাদুর এতে বাধা দেওয়ায় তাঁকেও ছুরিকাঘাত করে হত্যা করে খুনিরা।

রমনা থানার পরিদর্শক (অভিযান) সফিকুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, প্রাথমিক তদন্তে জানা গেছে পেশাদার খুনিরা এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে। এর সংখ্যা দুই থেকে তিনজন হতে পারে।

গত বুধবার সন্ধ্যায় কাকরাইলে ভিআইপি রোডে মায়াকাননের পঞ্চম তলার নিজ বাসায় শামসুন্নাহার (৪৬) ও তাঁর ছোট ছেলে সাজ্জাদুর করিম ওরফে শাওনকে (১৮) হত্যা করা হয়। তাঁদের নিকটাত্মীয় মোবারক হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, শুক্রবার রাতে শামসুন্নাহারের বড় ছেলে মশিউর করিম ও মেজ ছেলে আশিকুর রহমান অনিক বিদেশ থেকে ফিরবেন। এরপর মা ও ছেলের লাশ গ্রামের বাড়ি মুন্সিগঞ্জে দাফন করা হবে।