সাবেক পুলিশ সুপার (এসপি) বাবুল আক্তারের স্ত্রী মাহমুদা খানম ওরফে মিতু হত্যা মামলায় তাঁদের দুই সন্তানের সঙ্গে কথা বলতে চায় তদন্তকারী সংস্থা পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)।
হত্যার ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ছিল এই দম্পতির বড় ছেলে। বাসা থেকে বেরিয়ে ছেলেকে স্কুলবাসে তুলে দিতে যাওয়ার সময় ২০১৬ সালের ৫ জুন মাহমুদাকে কুপিয়ে ও গুলি করে হত্যা করা হয়।
বাবুলের নির্দেশে তাঁর সোর্স (তথ্যদাতা) কামরুল শিকদার ওরফে মুছা সহযোগীদের নিয়ে মাহমুদাকে খুন করেন বলে পিবিআইয়ের তদন্তে উঠে এসেছে। কিন্তু বাবুল কেন ভাড়াটে খুনি দিয়ে নিজের স্ত্রীকে খুন করালেন, সেই রহস্য এখনো উন্মোচিত হয়নি।
অবশ্য মাহমুদার বাবা অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তা মোশারফ হোসেন অভিযোগ করে আসছেন যে অন্য নারীর সঙ্গে সম্পর্কের কারণে বাবুল এ কাজ করেছেন।
তবে বাবুলের আইনজীবী ইফতেখার সাইমুল চৌধুরী দাবি করেন, এসব অভিযোগ বাবুলের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অংশ।
খুনের রহস্য উদ্ঘাটনে বাবুল-মাহমুদার দুই সন্তানকে (ছেলে-মেয়ে) গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষী উল্লেখ করে তাদের সঙ্গে কথা বলার জন্য আদালতে একটি আবেদন করা হয়েছে। পিবিআইয়ের এ আবেদনের ওপর আগামী রোববার চট্টগ্রাম নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-৭–এ (শিশু আদালত) শুনানি হওয়ার কথা রয়েছে।
চট্টগ্রাম নগরের ও আর নিজাম রোডের একটি বাসায় স্ত্রী মাহমুদা ও দুই সন্তানকে নিয়ে থাকতেন বাবুল।
মাহমুদা হত্যার ঘটনার বাবুল ও তাঁর শ্বশুর মোশারফের করা পৃথক মামলার তদন্ত করছেন পিবিআই চট্টগ্রামের পরিদর্শক আবু জাফর মুহাম্মদ ওমর ফারুক। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ছিল বাবুলের ছেলে। ছোট মেয়েও সাক্ষী হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ। আলোচিত এ মামলার রহস্য উদ্ঘাটনের জন্য দুজনের সঙ্গে কথা বলা প্রয়োজন।
ওমর ফারুক বলেন, এই দম্পতির দুই সন্তানকে পিবিআই কার্যালয়ে আনার জন্য বাবুলের বাবা ও ভাইয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। কিন্তু তাঁরা সাড়া দেননি। তাই আদালতে আবেদন করা হয়েছে। আদালতের আদেশ পাওয়া গেলে দুই সন্তানের সঙ্গে কথা বলা হবে।
পিবিআই বলছে, এখন পর্যন্ত তদন্তে যা পাওয়া গেছে, তাতে দেখা যাচ্ছে, মাহমুদাকে খুন করতে হত্যাকারীরা প্রথমে তাঁকে মোটরসাইকেল দিয়ে ধাক্কা মারেন। তিনি পড়ে যাওয়ার পর তাঁরা তাঁকে কোপান ও গুলি করেন। মাহমুদাকে যখন কোপানো হচ্ছিল, তখন তাঁর সাত বছরের ছেলে মায়ের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তাঁকে রক্ষার চেষ্টা করে। এ সময় তৎকালীন পুলিশ কর্মকর্তা বাবুলের সোর্স কামরুল ইসলাম শিকদার তাকে (ছেলে) ধরে রেখেছিলেন।
মাহমুদা হত্যাকাণ্ডের পর বাবুল বাদী হয়ে যে মামলা করেন, সেই মামলায় মো. ওয়াসিম ও মো. আনোয়ার নামের দুই আসামি স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। সেই জবানবন্দিতেও এ বিবরণ আছে বলে জানায় পিবিআই।
পিবিআই বলছে, গত বছরের ২৩ অক্টোবর এহতেশামুল হক ওরফে ভোলার দেওয়া জবানবন্দিতে উঠে আসে, বাবুলের নির্দেশে কামরুল শিকদার মাহমুদাকে খুন করেন। নির্দেশ অনুসারে কাজ না করলে কামরুলকে ক্রসফায়ারে দেওয়ার হুমকি দিয়েছিলেন বাবুল।
কামরুল ঘটনার পর থেকে ‘নিখোঁজ’। অবশ্য কামরুলের স্ত্রী পান্না আক্তারের দাবি, তাঁকে পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে। তার পর থেকে তাঁর আর খোঁজ পাচ্ছেন না তাঁরা।
মাহমুদা হত্যার পরদিন ২০১৬ সালের ৬ জুন তাঁর স্বামী বাবুল বাদী হয়ে নগরের পাঁচলাইশ থানায় মামলা করেন। তদন্ত শেষে পিবিআই গত বছরের ১২ মে মামলার চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দেয়।
একই দিন বাবুলের শ্বশুর মোশারফ বাদী হয়ে পাঁচলাইশ থানায় হত্যা মামলা করেন। এ মামলায় বাবুলসহ আটজনকে আসামি করা হয়।
বাবুলের করা মামলায় পিবিআইয়ের চূড়ান্ত প্রতিবেদনের বিরুদ্ধে গত বছরের ১৪ অক্টোবর আদালতে নারাজি আবেদন করেন তাঁর (বাবুল) আইনজীবী।
আবেদনে বলা হয়, বাবুলকে আসামি করতে বানোয়াট চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছে। অথচ এ মামলায় পুলিশ ৫১ জনের বেশি সাক্ষীর জবানবন্দি নিয়েছে ১৬১ ধারায়। সেখানে একজনও বাবুলের সম্পৃক্ততার কথা বলেননি। দুই সাক্ষীর জবানবন্দির ভিত্তিতে বাবুলকে আসামি করা হয়েছে। কাদের বাঁচানোর জন্য এ চূড়ান্ত প্রতিবেদন, সেটা দেখতে হবে। বাবুল আক্তার মহলবিশেষের ষড়যন্ত্রের শিকার। এর আগে তিনি সোনা চোরাকারবারি ও কালোবাজারিদের ধরেছেন। জঙ্গিবাদ প্রতিরোধ করেছেন।
গত ৩ নভেম্বর আদালত চূড়ান্ত প্রতিবেদনটি গ্রহণ না করে পিবিআইকে তদন্তের নির্দেশ দেন।
বর্তমানে দুটি মামলারই তদন্ত করছে পিবিআই। শ্বশুর মোশারফের করা মামলায় গ্রেপ্তার বাবুল এখন ফেনী কারাগারে।
বাবুলের শ্বশুর মোশারফ প্রথম আলোকে বলেন, দুই নাতি-নাতনিকে জিম্মায় পেতে তাঁরা ঢাকায় পারিবারিক আদালতে মামলা করেন। আদালত দুই সন্তানের খোঁজ নিতে পুলিশকে নির্দেশ দেন। কিন্তু পুলিশ তাদের খুঁজে পাচ্ছে না। তাদের লুকিয়ে রেখেছেন বাবুলের বাবা ও ভাই।
জানতে চাইলে বাবুলের ভাই হাবিবুর রহমান আজ শুক্রবার সকালে মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘দুই সন্তানকে হাজির করতে পিবিআই আমাদের লিখিতভাবে কিছু বলেনি। আদালতের আদেশ আমরা এখনো পাইনি। বাবুল-মাহমুদার দুই সন্তান ভালো আছে। তারা ঢাকায় আছে। দুই সন্তানের বিষয়ে আদালত যেভাবে নির্দেশ দেবেন, আমরা সেভাবে কাজ করব।’