বিচারকাজ শেষ হয়নি ১৭ বছরেও, বাদীকে হুমকি

আফতাব উদ্দিনকে ২০০৫ সালের ডিসেম্বরে গুলি করে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা। এ ঘটনায় তাঁর ভাই আফরোজ উদ্দিন হত্যা মামলা করেন।

আফতাব উদ্দিন

মিরপুরের ব্যবসায়ী আফতাব উদ্দিন হত্যা মামলার বিচারকাজ ১৭ বছরেও শেষ হয়নি। বিচারের রায় শোনার প্রহর গুনতে গুনতে আফতাবের মা এখন শয্যাশায়ী। ছেলে হত্যার বিচার আর পাবেন না বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন তিনি।

আফতাবের মা আফরোজা বেগম প্রথম আলোকে বলেন, ‘ছেলে হত্যার বিচার পেলাম না। রাতে ঠিকমতো আর ঘুম হয় না। সন্ত্রাসীরা বড় ছেলে ফিরোজ উদ্দিন ও নাতি জাহাঙ্গীর আলমকে খুন করল, তারও বিচার পেলাম না। মেজ ছেলে আফতাব হত্যারও বিচার হলো না। অনেক লোকের সামনে আফতাবকে গুলি করে মেরেছে। ’

এই মামলার আসামিরা মামলা তুলে নেওয়ার জন্য বাদী আফরোজ উদ্দিনের ও তাঁর পরিবারকে হত্যা–গুম করার হুমকি দিচ্ছে। এ বিষয়ে মামলার বাদী বিভিন্ন থানায় ৪৬টি জিডি করেছেন। কিন্তু পুলিশ ওই জিডির বিষয়ে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। এ জন্য নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন মামলার বাদী।

মামলা ও পুলিশ সূত্র জানায়, ২০০৫ সালের ২৫ ডিসেম্বর মিরপুর ২ নম্বরের ই-ব্লকের নিজ বাসার কাছে সন্ত্রাসীদের গুলিতে আহত হন ব্যবসায়ী আফতাব উদ্দিন। ২৮ ডিসেম্বর রাজধানীর পান্থপথের শমরিতা হাসপাতালে মারা যান তিনি। আফতাব উদ্দিন মিরপুর ১ নম্বরের মুক্তবাংলা শপিং কমপ্লেক্স পরিচালনা কমিটির সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। ওই ঘটনায় তাঁর ভাই ব্যবসায়ী আফরোজ উদ্দিন বাদী হয়ে শীর্ষ সন্ত্রাসী শাহাদত, খোরশেদ ও তাঁদের ১৩ সহযোগীর নাম উল্লেখসহ আরও পাঁচ-ছয়জন অজ্ঞাতনামা সন্ত্রাসীকে আসামি করে মিরপুর থানায় হত্যা মামলা করেন। র‌্যাব-৪ তদন্ত করে শীর্ষ সন্ত্রাসী শাহাদতসহ ১৯ জনের বিরুদ্ধে ২০০৭ সালের ৫ মে আদালতে অভিযোগপত্র দেন। এঁদের মধ্যে কারাগারে থাকা ৯ আসামির মধ্যে ১ নম্বর আসামি ওসমান গনিসহ ৭ জন কারাগার থেকে জামিনে মুক্ত হয়েছেন। এখন দুজন কারাগারে আছেন। শীর্ষ সন্ত্রাসী শাহাদতসহ ১০ জন পলাতক।

পুলিশ সূত্র জানায়, ওয়ার্ড কাউন্সিলর ছাইদুর রহমান ওরফে নিউটন হত্যাসহ দুটি মামলায় আদালত শাহাদতকে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দিয়েছেন। আর ছাইদুর রহমান হত্যা মামলায় খোরশেদও মৃত্যুদণ্ডাদেশপ্রাপ্ত। তাঁরা ১৭ বছর ধরে বিদেশে পালিয়ে আছেন।

আদালত সূত্র বলেছে, দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে আফতাব হত্যা মামলার বিচারকাজ চলার সময় ২০১০ সালের ৩ অক্টোবর সেটি ‘রাজনৈতিক হয়রানিমূলক’ হিসেবে চিহ্নিত করে বাতিল করা হয়েছিল। এ নিয়ে ওই বছরের ২৯ নভেম্বর প্রথম আলোতে খবর বের হলে মামলাটি পুনরুজ্জীবিত করা হয়। তবে অভিযোগপত্রভুক্ত ১৯ আসামির মধ্যে ১ নম্বর আসামি ওসমান গনিকে মামলা থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। ওই বছর ডিসেম্বরে হাইকোর্ট স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে রুল জারি করেন এবং পরের বছরের ২৬ জানুয়ারি মামলাটি রাজনৈতিক বিবেচনায় প্রত্যাহার হওয়ার আদেশ বাতিল ও সব আসামির বিরুদ্ধে মামলা চালানোর নির্দেশ দেন। পরদিন ২৭ জানুয়ারি হাইকোর্ট শাহাদতসহ ১৯ আসামির অব্যাহতির আদেশ বাতিল করেন।

সন্ত্রাসীরা বড় ছেলে ফিরোজ উদ্দিন ও নাতি জাহাঙ্গীর আলমকে খুন করল, তারও বিচার পেলাম না। মেজ ছেলে আফতাব হত্যারও বিচার হলো না।
আফরোজা বেগম, আফতাব উদ্দিনের মা

আদালত সূত্র জানায়, ২০১৬ সালে দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে বিচারকাজ চলার সময় মামলাটি সেখান থেকে ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালত প্রশাসনিক কারণ দেখিয়ে ওই আদালতে নেওয়া হয়। তখন মামলার বাদী আফরোজ উদ্দিন ওই আদেশের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে রিট করেন। গত জানুয়ারি মাসে হাইকোর্ট ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতের আদেশ স্থগিত করেন। জানুয়ারি মাসে মামলাটি দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে স্থানান্তর করা হয়।

মামলার বাদী আফরোজ উদ্দিন বলেন, আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেওয়া হত্যা মামলার অভিযোগপত্রভুক্ত আসামি রিয়াজ দেওয়ান ওরফে রেজা গত বছর করোনায় মারা গেছেন। আরেক আসামি মুন্সি এবাদুল ওই বছরে মারা যান। এ ছাড়া মামলার সাক্ষী মো. আতিক, সাবেক ওয়ার্ড কমিশনার আহসানউল্লাহ হাসান ও হাবিবুর রহমান মারা গেছেন। মামলার আসামিদের হুমকি–ধমকির মুখে কিছু সাক্ষী এলাকা ছেড়ে পালিয়ে গেছেন। বাকিরা আদালতে সাক্ষ্য দিতে ভয় পাচ্ছেন।

সর্বশেষ চলতি বছরের ২২ ফেব্রুয়ারি মিরপুর মডেল থানায় আফরোজ উদ্দিনের করা জিডিতে বলা হয়, হত্যা মামলার ১ নম্বর আসামি ওসমান গনি, শাহীন ও আরেক আসামি প্রভাবশালী। তাঁরা প্রভাব খাটিয়ে অজ্ঞাত ব্যক্তিদের দিয়ে তাঁকে ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের গুম-খুন করার পরিকল্পনা করছেন। তাঁর পরিবারকে ভয়ভীতি দেখাচ্ছেন।

মামলার অবস্থা জানতে রোববার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের সরকারি কৌঁসুলি আবু আবদুল্লাহ ভূঁইয়া বলেন, পাঁচ বছর ধরে মহানগর দায়রা জজ আদালতে থাকার সময় মামলাটি পড়ে ছিল। পরে বাদীর করা রিটের পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্ট প্রশাসনিক আদেশ স্থগিত করেন। সবেমাত্র মামলার বাদীর সাক্ষ্য নেওয়া শুরু হয়েছে। সবার সাক্ষী নেওয়া শেষ হলেই ওই মামলার রায়ের বিষয়টি আসবে।