পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ হয়ে ভারতে ঢোকে জাল রুপি: পুলিশ
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের সুনামগঞ্জ জেলার সরকারি গাড়িচালক আমানুল্লাহ ভূঁইয়া দীর্ঘদিন আন্তর্জাতিক পাচার চক্রের মাধ্যমে পাকিস্তান থেকে ভারতীয় জাল মুদ্রা বাংলাদেশ হয়ে ভারতে পাচার করে আসছিলেন। চক্রের সদস্যরা শুঁটকি মাছ, মোজাইক পাথরসহ বিভিন্ন পণ্যের বস্তার ভেতরে ভারতীয় জাল রুপির সুপার নোট কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে বাংলাদেশের চাঁপাইনবাবগঞ্জ এলাকায় আনতেন। এরপর সেগুলো কৌশলে সংগ্রহ করেন, তা ভারতে থাকা তাঁদের চক্রের সদস্যের মাধ্যমে পাচার করতেন। ভারতীয় জাল মুদ্রার কারবারে জড়িত গ্রেপ্তার করা চার সদস্যকে জিজ্ঞাসাবাদে এসব তথ্য পেয়েছে বলে জানিয়েছে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা বিভাগ (ডিবি)।
গত সোম ও মঙ্গলবার রাজধানীর ডেমরা ও হাজারীবাগে অভিযান চালিয়ে ভারতীয় জাল মুদ্রার কারবারে জড়িত চারজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। এ সময় তাঁদের কাছ থেকে ১৫ লাখ ভারতীয় জাল মুদ্রা ও মুঠোফোন উদ্ধার করা হয়। গ্রেপ্তার ব্যক্তিরা হলেন মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের সুনামগঞ্জ জেলার সরকারি গাড়িচালক আমানুল্লাহ ভূঁইয়া (৫২), তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রী আইনজীবী কাজল রেখা (৩৭), ইয়াসিন আরাফাত কেরামত (৩৩) ও নোমানুর রহমান খান (৩১)।
আজ বুধবার দুপুরে রাজধানীর মিন্টো রোডে ডিএমপির মিডিয়া সেন্টারে এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানানো হয়। এতে ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (ডিবি) এ কে এম হাফিজ আক্তার বলেন, গত বছরের নভেম্বরে খিলক্ষেত থানায় ৭ কোটি ৩৫ লাখ ভারতীয় জাল রুপি পাচারসংক্রান্তে হওয়া একটি মামলা গুলশান গোয়েন্দা বিভাগ তদন্তের দায়িত্ব পায়। মামলার তদন্তে প্রাপ্ত তথ্য বিশ্লেষণের মাধ্যমে গত ৭ ফেব্রুয়ারি গোয়েন্দা গুলশান বিভাগের একাধিক দল পুরান ঢাকার নাজিমুদ্দিন রোড এলাকা থেকে নোমানুর রহমান খানকে গ্রেপ্তার করে। জিজ্ঞাসাবাদে নোমান বলেছেন, পাকিস্তানে অবস্থানকারী তাঁর ভাই মো. ফজলুর রহমান বিভিন্ন সময়ে পাকিস্তান থেকে আকাশ ও সমুদ্রপথে বিভিন্ন পণ্যসামগ্রী ও ভারতীয় ৫০০ টাকার জাল মুদ্রা বিভিন্ন ব্যক্তির মাধ্যমে বাংলাদেশে পাঠিয়ে আসছিলেন। নোমান আরও বলেছেন, সাম্প্রতিক সময়ে পাচার করা জাল রুপির বড় একটি চালানের এক অংশসহ তাঁর ভাই সাইদুর রহমান, আমদানিকারক আবু তালেব, সমন্বয়কারী ফাতেমা আক্তার ও অন্যরা ইতিপূর্বে গ্রেপ্তার হলেও অন্যদের হাজারীবাগে অবস্থানকারী কাজল রেখা এবং আমানদের হেফাজতে রাখা হয়।
ডিবি প্রধান হাফিজ আক্তার বলেন, গ্রেপ্তার নোমানের দেওয়া তথ্য বিশ্লেষণ করে রাজধানীর হাজারীবাগ এলাকায় বিশেষ অভিযান চালিয়ে ২১ নম্বর মনেশ্বর রোড থেকে ইয়াসির আরাফাত ওরফে কেরামত ও আমান উল্লাহ ভূঁইয়াকে আটক করা হয়। তাঁদের কাছ থেকে ৬ লাখ করে মোট ১২ লাখ জাল ভারতীয় মুদ্রা উদ্ধার করা হয়। গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের তথ্যের ভিত্তিতে কাজল রেখার বাসায় অভিযান চালিয়ে আরও তিন লাখ ভারতীয় জাল মুদ্রাসহ তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়।
সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেপ্তার ব্যক্তিরা বলেন, তাঁরা দীর্ঘদিন যাবৎ পাকিস্তান থেকে আন্তর্জাতিক চক্রের কাছ থেকে ভারতীয় জাল মুদ্রা কৌশলে সংগ্রহ করতেন। এরপর বিভিন্ন পণ্যের বস্তার ভেতর, শরীরে বেঁধে বা কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ এলাকা দিয়ে ভারতে পাচার করে আসছিলেন। দীর্ঘদিন যাবৎ জাল মুদ্রা পাচারকারী এ চক্রের কেন্দ্রে আছে মূলত দুটি পরিবার। এর মধ্যে একটি পরিবার মুন্সিগঞ্জ জেলার শ্রীনগরে। এই পরিবারের অধিকাংশ সদস্য একসময় পাকিস্তানে থাকতেন। এখন এ পরিবারের জ্যেষ্ঠ সদস্য ফজলুর রহমান পাকিস্তানের করাচিতে থেকে পাকিস্তানকেন্দ্রিক মাফিয়াদের কাছ থেকে উন্নত মানের জাল রুপি সংগ্রহ করেন। আর সেসব জাল মুদ্রা কখনো শুঁটকি, কখনো মোজাইক পাথর ও অন্যান্য নির্মাণসামগ্রীর বস্তার মধ্যে সমুদ্রপথে বাংলাদেশ পাঠাতেন। এ কাজে তাঁকে সহযোগিতা করতেন তাঁর ভাই সাইদুর রহমান রহমান, নোমানুর রহমান ও ভগ্নিপতি শফিকুর রহমান। আমদানিকারক ব্যক্তিদের সঙ্গে মিলে পাকিস্তানের করাচি বন্দর থেকে শ্রীলঙ্কা হয়ে চট্টগ্রাম বন্দরে কনটেইনারের মাধ্যমে ভারতীয় জাল মুদ্রা আনা হতো। পরে ওই চক্র জাল মুদ্রা খালাস করে গুদামে মজুত করা, বিভিন্ন মাধ্যমে তা ডিলারদের মধ্যে সরবরাহ করা এবং বিক্রয় করা জাল মুদ্রার অর্থ বিভিন্ন ব্যাংকের মাধ্যমে সংগ্রহ করে পরবর্তী সময়ে হুন্ডিতে করে পাকিস্তানে পাচার করতেন।
হাফিজ আক্তার বলেন, ১ লাখ ভারতীয় জাল মুদ্রা ৩৮ হাজার টাকায় কিনে ৪০-৪২ হাজার টাকায় বিক্রি করে আসছিল। প্রতি লাখ ভারতীয় জাল মুদ্রা বিক্রি করে চক্রের সদস্যরা তিন-চার হাজার টাকা করে পেতেন।
অভিযান তদারক কর্মকর্তা মশিউর রহমান প্রথম আলাকে বলেন, চক্রের সদস্যরা সীমান্ত দিয়ে ভারতে জাল রুপি পাচার ছাড়াও সোনামসজিদ স্থলবন্দরে ফেনসিডিল, অস্ত্র, চোরাই মুঠোফোন, গাজাসহ বিভিন্ন নিষিদ্ধ সামগ্রী বেচাকেনায় ভারতীয় জাল মুদ্রা ব্যবহার করা হতো। স্থানীয় গোমস্তাপুর এবং শিবগঞ্জের সীমান্ত দিয়ে স্থানীয় মোস্তফা, হাবিল, আয়নাল, মাসুদ, নীলসন, একরাম ইয়াদুরেরা ভারতীয় মুদ্রা পাচার করেন। তিনি বলেন, গ্রেপ্তার চার ভারতীয় জাল মুদ্রা কারবারিকে আজ ১০ দিনের রিমান্ডের আবেদন জানিয়ে ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালতে পাঠানো হয়। শুনানি শেষে আদালত পাঁচ দিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করেন।