সিলিং ফ্যানে ঝুলছিল মা-মেয়ের লাশ, ছেলের লাশ পড়ে ছিল বিছানায়

চট্টগ্রাম নগরের পাঁচলাইশ থানার এসএস হাউস নামের আবাসিক এলাকার একটি ভবনের ফ্ল্যাট থেকে তিনজনের লাশ উদ্ধার করা হয়
ছবি: জুয়েল শীল

সান বাবুর বয়স তিন বছর। জান্নাত মায়মুনের সাত বছর। তারা ভাই–বোন। ছোট ভাইকে সঙ্গে নিয়ে জান্নাত সারক্ষণ নানান খেলা খেলত। এ কারণে মা সুমিতা খাতুনের কাছ থেকে তারা প্রায় স্নেহমাখা মুখে বকাও খেত। সান ও জান্নাত আর খেলবে না। মা-ও তাদের আর শাসন করবেন না।

চট্টগ্রাম নগরের পাঁচলাইশ থানার মুরাদপুর রেললাইনের পূর্ব দিকের ইসমাইল কলোনির এসএস হাউস নামের একটি আবাসিক এলাকার সাততলা ভবনের একটি ফ্ল্যাটে ভাড়া থাকত পরিবারটি। আজ শুক্রবার সকালে ফ্ল্যাট থেকে সুমিতা, জান্নাত ও সানের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ।

পুলিশ জানায়, ফ্ল্যাটের শোবার ঘরের সিলিং ফ্যানের সঙ্গে বাধা একটি দড়িতে ঝুলছিল সুমিতার লাশ। একই ফ্যানে আরেকটি দড়িতে ঝুলছিল জান্নাতের লাশ। সিলিং ফ্যানের নিচে শোবার খাটে পড়ে ছিল সানের লাশ।

সুমিতার স্বামী সোহেল রানা। নগরের মুরাদপুর এলাকায় তাঁর হারবালের একটি দোকান আছে। তাঁদের গ্রামের বাড়ি সিরাজগঞ্জে।

খবর পেয়ে আজ সকালে ফ্ল্যাটের ফটকের তালা ভেঙে ভেতরে প্রবেশ করে পুলিশ। তারা বাসার শোবার ঘরে সিলিং ফ্যানের সঙ্গে সুমিতা ও জান্নাতের ঝুলন্ত লাশ পায়। সানের লাশটি খাটে পড়ে থাকতে দেখে।

ঠিক কী কারণে একই পরিবারের তিন সদস্য লাশ হলো, তা তাৎক্ষণিকভাবে জানাতে পারেনি পুলিশ। এই ঘটনায় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য সোহেলকে পুলিশ হেফাজতে নিয়েছে।

আজ সকাল ১০টায় ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা যায়, বাসাটির সামনে অনেক মানুষের ভিড়। তাঁদের সবার একটাই প্রশ্ন, একই পরিবারের তিনজন কী করে লাশ হলো?
ভবনটির তিনতলার একটি ফ্ল্যাটে আড়াই বছর ধরে পরিবার নিয়ে ভাড়া থাকেন সোহেল। ফ্ল্যাটটিতে দুটি শোবার ঘর ও একটি বসার ঘর রয়েছে।

ফ্ল্যাটের ভেতরে ঢুকে দেখা যায়, একটি শোবার ঘরে সিলিং ফ্যানের সঙ্গে ঝুলন্ত অবস্থায় আছেন সুমিতা। একই ফ্যানে আরেকটি দড়িতে ঝুলন্ত অবস্থায় আছে জান্নাত। ফ্যানের নিচে বিছানায় পড়ে আছে সান। তার গলায় কাপড় প্যাঁচানো। ঘটনাস্থল থেকে পুলিশ বিভিন্ন আলামত সংগ্রহ করছে।
সোহেলের এক বোন তাঁর স্বামীসহ চট্টগ্রাম নগরে থাকেন। বোনের নাম লিপি আক্তার। খবর পেয়ে তিনি ঘটনাস্থলে ছুটে আসেন।

লিপি প্রথম আলোকে বলেন, সোহেলে সঙ্গে সুমিতার মারাত্মক কোনো পারিবারিক দ্বন্দ্বের কথা তাঁর জানা নেই। তবে তাঁদের মধ্যে মাঝে মাঝে ঝগড়া হতো। কী কারণে তিনজন লাশ হলো, তা তিনি বুঝতে পারছেন না।

লিপি বলেন, সানকে নিয়ে সারাক্ষণ খেলত জান্নাত। কত সুন্দর একটি পরিবার ছিল। সব শেষ হয়ে গেল।

সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে এই ঘটনার রহস্য উদ্‌ঘাটনের দাবি জানান লিপি। লিপির স্বামী নজরুল ইসলামও একই কথা বলেন।

বাসাটির নিরাপত্তা প্রহরী মো. ফোরকান প্রথম আলোকে বলেন, গতকাল বৃহস্পতিবার রাত নয়টায় ফ্ল্যাটে আসেন সোহেল। কিন্তু ভেতর থেকে ফ্ল্যাটের দরজা বন্ধ থাকায় একপর্যায়ে তিনি চলে যান। দিবাগত রাত ১২টায় তিনি আবার ফ্ল্যাটে আসেন। বারবার ডাকাডাকি করা হলেও ফ্ল্যাটের ভেতর থেকে কোনো শব্দ পাওয়া যায়নি। দিবাগত রাত তিনটায় ফ্ল্যাটের দরজায় ধাক্কা দেওয়া হয়। তারপরও কোনো সাড়া না পেয়ে পুলিশের জরুরি সেবা ৯৯৯ নম্বরে কল দেন সোহেল। পুলিশ এসে ডাকাডাকি করেও ফ্ল্যাটের দরজা খুলতে পারেনি। পরে আজ সকালে ফ্ল্যাটের দরজা ভেঙে পুলিশ ভেতরে ঢোকে। এ সময় শোবার ঘরের দরজাও বন্ধ ছিল। সেটিও ভাঙে পুলিশ। ভেতরে ঢুকে পুলিশ সিলিং ফ্যানের সঙ্গে মা-মেয়ের ঝুলন্ত লাশ দেখে। আর বিছানায় পড়ে থাকতে দেখে ছেলের লাশ।

এক প্রশ্নের জবাবে ফোরকান বলেন, ‘স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে কোনো দ্বন্দ্ব ছিল কি না, তা আমি জানি না।’

এসএস হাউস নামের আবাসিক এলাকার একটি ভবনের ফ্ল্যাট থেকে আজ শুক্রবার সকালে মা-মেয়ে-সন্তানের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ
ছবি: জুয়েল শীল

সোহেলের পাশের ফ্ল্যাটে থাকেন রফিক উদ্দিন। তিনি বলেন, গতকাল রাতে ওই ফ্ল্যাটের (সোহেলের) দরজায় ধাক্কাধাক্কির আওয়াজ শুনেছেন তিনি। এর বেশি কিছু তাঁরা জানেন না। তাঁদের সঙ্গে সোহেলের পরিবারের কোনো যোগাযোগ ছিল না।
ঘটনাস্থলে আসা নগর পুলিশের উপকমিশনার (উত্তর) মোখলেসুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, পুলিশ দরজা ভেঙে তিনজনের লাশ পায়। শোবার ঘরের ভেতরের দুটি সিটকিনিও লাগানো ছিল। শোবার ঘরের দরজা–জানালা সব ঠিকঠাক আছে। বাইরের কারও ভেতরে আসার সুযোগ নেই। বাসার জিনিসপত্রও সব ঠিকঠাক আছে। প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে, দুই সন্তানকে হত্যার পর মা আত্মহত্যা করেছেন। বিভিন্ন আলামত সংগ্রহ করা হচ্ছে। বাকিটা ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন ও তদন্তে স্পষ্ট হবে।
এই ঘটনার পেছনে কী কারণ থাকতে পারে, এমন প্রশ্নের জবাবে এই পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, পারিবারিক কলহের জেরে এমনটা হতে পারে।

ঘটনাস্থলে আসা পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) চট্টগ্রাম মেট্রো পুলিশ সুপার নাইমা সুলতানা বলেন, তাঁরও ধারণা, দুই সন্তানকে হত্যার পর মা আত্মহত্যা করেছেন।

নাইমা সুলতানা প্রথম আলোকে বলেন, ‘সবকিছু দেখে মনে হচ্ছে, পারিবারিক কারণে দুই সন্তানকে হত্যার পর মা আত্মহত্যা করেছেন।

লাশ তিনটি উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের মর্গে পাঠানো হয়েছে বলে আজ দুপুরের দিকে প্রথম আলোকে জানান পাঁচলাইশ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) জাহিদুল কবির। তিনি বলেন, আত্মহত্যা ছাড়া অন্য কোনো কারণ এই ঘটনার পেছনে আছে কি না, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।

আগের দিন বৃহস্পতিবার সকালে চট্টগ্রামের মিরসরাই উপজেলার জোরারগঞ্জ মধ্যম সোনাপাহাড় এলাকার একটি বাড়ি থেকে মা, বাবা ও ছেলের গলাকাটা লাশ উদ্ধার করা হয়। এই ঘটনায় সাদেক হোসেন নামের এক ছেলেকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তিনি সম্পত্তি নিয়ে বিরোধের জেরে তিনজনকে হত্যার কথা স্বীকার করেন।