মাছ ধরার পেশা ছেড়ে মাদক ব্যবসায় পুরো পরিবার, এখন তারা ‘অনেক টাকার’ মালিক

রত্তন হাওলাদারের বাড়ি। শুক্রবার সকালে পিরোজপুরের মঠবাড়িয়া পৌরসভার দক্ষিণ মিঠাখালী গ্রামে
ছবি: প্রথম আলো

রত্তন হাওলাদার (৬৫) একসময় মাছ ধরে সংসার চালাতেন। পরিবার নিয়ে থাকতেন ঝুপড়িতে। মাদক ব্যবসায় জড়িয়ে বছর দশকের মধ্যে তাঁর অবস্থা বদলে গেছে। হয়েছেন অনেক টাকার মালিক, ঝুপড়ি ভেঙে নির্মাণ করেছেন পাকা বাড়ি। এলাকায় প্রভাবশালী হয়ে ওঠায় তাঁদের বিরুদ্ধে কেউ কথাও বলতে সাহস পান না।

রত্তন হাওলাদারের বাড়ি পিরোজপুরের মঠবাড়িয়া পৌরসভার দক্ষিণ মিঠাখালী মহল্লায়। গোপন সংবাদের ভিত্তিতে গত মঙ্গলবার রাতে তাঁর বাড়িয়ে অভিযান চালিয়ে মাদকের একটি বড় চালান উদ্ধার করে জেলা গোয়েন্দা পুলিশের একটি দল। এ সময় পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হন রত্তন হাওলাদার, তাঁর স্ত্রী নূরজাহান বেগম (৬০), ছেলে আবুল বাশার (৩০), মেয়ে আসমা আক্তার (২৩) ও ভাড়ায়চালিত মোটরসাইকেল চালক মাহাবুব হাওলাদারকে (৩২)।

আরও পড়ুন

এ ঘটনায় ডিবির উপপরিদর্শক (এসআই) জ্যোতির্ময় হাওলাদার বাদী হয়ে পাঁচজনের বিরুদ্ধে স্থানীয় থানায় মামলা করেন। মামলাটির তদন্ত করছেন পিরোজপুর জেলা গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি-দক্ষিণ) পরিদর্শক এ কে এম এ মাহফুজুল হক। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, রত্তন হাওলাদারের পরিবারের সবাই মাদক ব্যবসায়ী। তাঁদের প্রত্যেকের নামে মাদক ব্যবসা রয়েছে। রত্তন হাওলাদারের বিরুদ্ধে দুটি, তাঁর স্ত্রী নূরজাহান বেগমের বিরুদ্ধে চারটি, ছেলে কালাম হাওলাদার ও আবুল বাশারের বিরুদ্ধে দুটি ও মেয়ে আসমা আক্তারের বিরুদ্ধে তিনটি মামলা রয়েছে।

পিরোজপুরের মঠবাড়িয়ায় ইয়াবা, আইসসহ গ্রেপ্তার পরিবারের সদস্যরা প্রত্যেকে মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত বলে জানিয়েছে পুলিশ
ছবি: প্রথম আলো

স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বছর দশেক আগে প্রথম মাদক ব্যবসায় জড়িয়ে পড়েন রত্তনের ছেলে কালাম হাওলাদার। এরপর রত্তন, তাঁর স্ত্রীসহ পুরো পরিবার জড়িয়ে পড়ে মাদকের কারবারে। মঠবাড়িয়া পৌরসভার ৩ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক পৌর কাউন্সিলর হেমায়েত উদ্দিন বলেন, শুনেছি তাঁদের অনেক টাকা হয়েছে। এদের পেছনে প্রভাবশালী চক্র রয়েছে। এ কারণে বারবার গ্রেপ্তার হওয়ার পরেও তাঁরা জামিনে মুক্ত হয়ে এসে আবার মাদক কারবারে জড়িত হচ্ছেন।

পরিবারের চার সদস্য গ্রেপ্তার ও এক সদস্য পলাতক থাকায় রত্তন হাওলাদারদের বক্তব্য জানা সম্ভব হয়নি।

গত মঙ্গলবার রত্তন হাওলাদারের বাড়ি থেকে ১২ গ্রাম ক্রিস্টাল মেথ বা আইস, ২ হাজার ৫০০টি ইয়াবাবড়ি ও সাড়ে চার কেজি গাঁজা, মাদক পরিমাপের ইলেকট্রিক নিক্তি ও ৪৫ হাজার টাকা উদ্ধার করে পুলিশ। ডিবির উপপরিদর্শক (এসআই) জ্যোতির্ময় হাওলাদার বলেন, রত্তন হাওলাদারের ছেলে কালাম চট্টগ্রামে থাকেন। সেখান থেকে নৌপথে মাদক কুয়াকাটা পাঠান। এরপর কুয়াকাটা থেকে মঠবাড়িয়ায় আসে ওই মাদক। মাদকের যে চালানটি জব্দ করা হয়েছে, সেটি চট্টগ্রাম থেকে এসেছিল।

মাদক রাখার জন্য পাকা বাড়ির দেয়ালে করা হয়েছে গর্ত
ছবি: প্রথম আলো

ডিবির পরিদর্শক এ কে এম এ মাহফুজুল হক বলেন, চট্টগ্রাম থেকে আসা মাদক পরিবারের সদস্যরা স্থানীয় মাদকসেবী ও ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করেন। মাদক রাখার জন্য রত্তন হাওলাদারের পাকা বাড়ির দেয়ালে গর্ত করে এবং রান্না ঘরের পাকা চুলার নিচে বক্স করা আছে। সেখানে তাঁরা ইয়াবা বড়ি ও আইস রাখেন। গ্রেপ্তার পাঁচজনকে আদালতে সোপর্দ করে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য পাঁচ দিন করে রিমান্ডের আবেদন করা হয়েছে। রিমান্ড আবেদনের শুনানি হয়নি।

পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, ২০১৪ সালের ২৮ মে দুপুরে উপজেলার বড়মাছুয়া স্টিমারঘাট এলাকায় রত্তন হাওলাদারের ছেলে কালাম হাওলাদারকে ৮০০টি ইয়াবাবড়ি ও পাঁচ কেজি গাঁজাসহ গ্রেপ্তার করে পুলিশ। ওই ঘটনায় করা মামলায় গত ২৬ সেপ্টেম্বর পিরোজপুরের অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ আসামি কালামের অনুপস্থিতে তাঁকে ১২ বছর কারাদণ্ড দেন। ২০১৮ সালের ৪ অক্টোবর রত্তন হাওলাদারের বাড়িতে অভিযান চালিয়ে ৫০০টি ইয়াবা বড়িসহ রত্তনের স্ত্রী নূরজাহান ও মেয়ে আসমাকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। এ ঘটনায় ২০২১ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর পিরোজপুরের অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ আসামি আসমাকে পাঁচ বছর ও তাঁর মা নূরজাহানকে তিন বছরের কারাদণ্ড দেন। পরে তাঁরা উচ্চ আদালত থেকে জামিনে মুক্ত হন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক তিনজন প্রতিবেশী বলেন, রত্তন হাওলাদারের পরিবারটি মাদক ব্যবসায় জড়িত এটা সবাই জানে। ভয়ে এদের বিরুদ্ধে কেউ কথা বলে না। ওই বাড়িতে মাদক ব্যবসায়ী ও মাদকসেবীরা নিয়মিত যাতায়াত করেন। রাতে তাঁদের বাসায় মাদকসেবীদের আসর বসে। পরিবারটি হত দরিদ্র ছিল। এখন তাঁরা মাদক ব্যবসা করে অনেক টাকার মালিক। ২০ লাখ টাকা খরচ করে পাকা বাড়ি তৈরি করেছেন।

রত্তন হাওলাদারের প্রতিবেশী মঠবাড়িয়া উপজেলা পরিষদের সাবেক নারী ভাইস চেয়ারম্যান রমা রানী মজুমদার। তিনি বলেন, রত্তন হাওলাদার মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করতেন। বর্তমানে পরিবারটি মাদক কেনাবেচা করে অনেক টাকা মালিক হয়েছেন। মঠবাড়িয়া পৌরসভায় ও সোনাখালী এলাকায় জমি কিনেছেন। পরিবারটি খুবই ভয়ংকর। পুলিশকে তাঁদের ব্যাপারে তথ্য দেওয়ার সন্দেহে একবার তাঁকে কুপিয়ে জখম করেছিলেন।

রত্তন হাওলাদার পেশায় ছিলেন জেলে। বাড়ির পাশের খালে ছোট জাল দিয়ে মাছ ধরতেন। এক দশক আগে তাঁর ছেলে কালাম হাওলাদার মাদক ব্যবসা শুরু করেন। এরপর কালাম হাওলাদার চট্টগ্রাম থেকে নৌপথে মঠবাড়িয়া মাদক পাচার শুরু করেন। কালাম পরিবারের অন্য সদস্যদের মাদকের ব্যবসায় যুক্ত করেন।

দক্ষিণ মিঠাখালী গ্রামের উন্নয়নকর্মী মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, মাদক ব্যবসার কারণে কয়েক বছর আগে স্থানীয় লোকজন রত্তনের ঘরটি ভেঙে ফেলেছিল। তবে এখন পরিবারটি রহস্যজনক কারণে খুবই প্রভাবশালী হয়ে উঠেছে। কয়েক মাস আগে দোতলা টিনসেট পাকা ঘর তৈরি করেছেন। বাড়িটি সুরক্ষিত করার জন্য উঁচু প্রাচীর নির্মাণ করা হয়েছে। তাঁরা অনেক টাকার মালিক হওয়ায় বিভিন্ন সময়ে কারাগারে গেলেও আবার জামিনে বেরিয়ে আসেন।