অতিবৃষ্টিতে আমনে বালাইনাশক দিয়ে কূল পাচ্ছেন না কৃষক

মরা ধান হাতে দাঁড়িয়ে আছেন নওগাঁর মান্দা উপজেলার কালীগ্রামের কৃষক হযরত আলী
প্রথম আলো

অতিবৃষ্টির কারণে আমন ধানের পোকা দমনের জন্য বালাইনাশক দিয়ে কোনো কিনারা করতে পারছেন না চাষিরা। সকালে বালাইনাশক ছিটাচ্ছেন, দুপুরেই বৃষ্টি হচ্ছে। ধুয়ে যাচ্ছে ওষুধ। ফলে নতুন করে আবার বালাইনাশক দিতে হচ্ছে। কৃষি কর্মকর্তারা বলছেন, বালাইনাশক ছিটানোর পরে অন্তত ৭২ ঘণ্টা রাখতে না পারলে সেই বালাইনাশকে কোনো কাজ হয় না।

রাজশাহীতে এবার বর্ষা মৌসুম শুরু হওয়ার পরে খুব কম দিনই রয়েছে, যেদিন একেবারেই বৃষ্টি হয়নি। শুধু রাজশাহীতে নয়, এর পার্শ্ববর্তী এলাকাগুলোতেও একই অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।

রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, এবার জেলায় ৭৭ হাজার ৫৭০ হেক্টর জমিতে আমন চাষ হয়েছে। এর মধ্যে ৫২১ হেক্টর জমির ফসল বন্যায় ডুবে গেছে। বাকি যে পরিমাণ জমিতে ফসল রয়েছে, তা ভালো রয়েছে। তবে চাষিরা বলছেন, এবার আমন ভালো রাখতে তাঁদের প্রাণান্তকর চেষ্টা ছিল। রাজশাহীর শতকরা ৬০ ভাগের বেশি আমন চাষ হয় তানোর ও গোদাগাড়ী উপজেলায়। এই দুই উপজেলার আমনচাষিরাও এবার তাঁদের দুর্ভোগের কথা জানিয়েছেন।

তানোরের নূর মোহাম্মদ জানান, প্রতিবছর দুবার বালাইনাশক ছিটালেই ধান হয়ে যায়। বেশি হলে কখনো তিনবার দিতে হয়েছে। এবার তানোরের ধানের এখনো শিষ বের হয়নি। কেবল থোড় পর্যায়ে রয়েছে। এখনই তিনবার বালাইনাশক দিতে হয়েছে। আরও অন্তত দুবার না দিলে এবার ধান ঘরে তুলতে পারবেন না। আগাম কিছু জাতের শিষ বের হয়েছে, তাতে অন্তত পাঁচবার ওষুধ দিতে হয়েছে।

গোদাগাড়ীর মাদারপুর এলাকার চাষি নাজমুল হক বলেন, এবার বর্ষা বেশি, তাই ধানে বিষ দিতে হচ্ছে। প্রতিবার দু–তিনবার দিলেই হতো। এবার পাঁচ-ছয়বার পর্যন্তু দিতে হয়েছে।

ধানের খেত দেখায়ে আর কোনো লাভ নাই। যা ধান উঠবে বিষের (বালাইনাশক) দাম দিতেই শেষ হয়ে যাবে।
আবদুল কুদ্দুস, কৃষক, কালীগ্রাম, মান্দা, নওগাঁ

রাজশাহীর পাশের নওগাঁর মান্দা উপজেলায় অতিবৃষ্টির কারণে চাষিদের দুর্ভোগ বেশি হচ্ছে। গত ২৭ সেপ্টেম্বর মান্দা উপজেলার কালীগ্রামে গিয়ে চাষিদের সঙ্গে কথা বলতে চাইলে একেকজন চাষি বাড়ি থেকে ১০–১৫টি করে কীটনাশকের বোতল বের করে দেখান। তাঁদের একজন হযরত আলী (৫০)। তিনি তাঁর জমি দেখাতে নিয়ে গেলেন। তাঁর সব খেতেই ধানের শিষ বের হয়েছে। একটি জমিতে সাতবার বালাইনাশক দেওয়ার পরও কী পরিমাণ মরা ধান রয়েছে, তা তুলে দেখান। তিনি একটি ধানের গোছা ধরে দেখান। যতগুলো গোড়া ছিল, তার অর্ধেকের শিষ বের হতে পারেনি। পাশে তার আরেকটি ভালো খেত দেখিয়ে বললেন, এই খেত ভালো রাখতে তাঁকে নয়বার বালাইনাশক দিতে হয়েছে।

বালাইনাশক ছিটানোর পর অন্তত ৭২ ঘণ্টা পর্যন্ত না থাকলে কোনো কাজ হয় না। বালাইনাশক ছিটানোর পরপরই বৃষ্টি হচ্ছে। চাষিরা কৃষি বিভাগের পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধ দিচ্ছেন, কিন্তু তা বৃষ্টিতে ধুয়ে যাচ্ছে।

মাঠ থেকে ফেরার পথে কুদ্দুস নামের একজন চাষি ডেকে বললেন, ‘ধানের খেত দেখায়ে আর কোনো লাভ নাই। যা ধান উঠবে বিষের (বালাইনাশক) দাম দিতেই শেষ হয়ে যাবে।’

মান্দা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা রাকিবুল হাসান প্রথম আলোকে বলেন, উপজেলায় ১৬ হাজার হেক্টর জমিতে আমন চাষ হয়েছে। এর মধ্যে ৭২৫ হেক্টর জমির ধান বন্যার পানিতে ডুবে গেছে। তিনি বলেন, বালাইনাশক ছিটানোর পর অন্তত ৭২ ঘণ্টা পর্যন্ত না থাকলে কোনো কাজ হয় না। বালাইনাশক ছিটানোর পরপরই বৃষ্টি হচ্ছে। চাষিরা তাঁদের পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধ দিচ্ছেন, কিন্তু তা বৃষ্টিতে ধুয়ে যাচ্ছে। ফলে আশানুরূপ কাজ হচ্ছে না। তিনি বলেন, রাজশাহী থেকে ধান গবেষণার কয়েকজন বিজ্ঞানী তাঁর এলাকার খেত পরিদর্শন করে একই অভিমত দিয়েছেন।

রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মো. শামছুল হক বলেন, এবার চাষিরা ধানের ভালো দাম পেয়েছেন। এ জন্য তাঁরা ধানের প্রতি অতি যত্নশীল। তাই বেশি পরিচর্যা করছেন। বালাইনাশক বেশি দিচ্ছেন। আর বৃষ্টির কারণে তো সমস্যা হচ্ছেই।