অভয়নগরে তরুণকে নির্যাতনের ভিডিও ফেসবুকে ভাইরাল

নির্যাতনের শিকার ওবায়দুল ইসলাম (২২)
ছবি: প্রথম আলো

যশোরের অভয়নগর উপজেলায় এক তরুণকে নির্যাতনের ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়েছে। গতকাল সোমবার রাত থেকে ওই তরুণের নির্যাতনের ভিডিও ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ে। আজ সারা দিন নওয়াপাড়ায় আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু ছিল ওই ভিডিও।

নির্যাতনের শিকার ওই তরুণের নাম ওবায়দুল ইসলাম (২২)। তিনি অভয়নগর উপজেলার কোটা গ্রামের আব্বাস মোল্যার ছেলে। তিনি যশোরের অভয়নগরের নওয়াপাড়াকেন্দ্রিক সার, খাদ্যশস্য ও কয়লা আমদানিকারী প্রতিষ্ঠান নওয়াপাড়া গ্রুপে স্কেলম্যান (ওজন পরিমাপক) হিসেবে কর্মরত ছিলেন। গম ‘চুরির অপরাধে’ সেখানে তিনি নির্যাতনের শিকার হন।

ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া ভিডিওটি ২৪ সেকেন্ডের। ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে, একটি ঘরের ভেতরে টেবিল-চেয়ারের পাশে একজন তরুণকে চ্যাংদোলা করে ধরে রাখা হয়েছে। ওই তরুণের দুই পাশে দুই তরুণ তাঁর এক হাত ও এক পা উঁচু করে ধরে রেখেছেন। পেছনে দাঁড়িয়ে আছেন দুজন। তাঁদের একজনের পরনে হাফহাতা লাল শার্ট, আরেকজনের পরনে ফুলহাতা সাদা গেঞ্জি। মাথায় খয়েরি রঙের ক্যাপ। লাল শার্ট পরিহিত ব্যক্তি বলছেন, ধরো ধরো ধরো, ভালো করে ধরো। হাতে লাগবে না। এরপর সাদা গেঞ্জি পরিহিত ব্যক্তি দুই হাতে মোটা লাঠি দিয়ে ওই তরুণের পশ্চাদ্দেশে বেদম পেটাচ্ছেন।
লাশ শার্ট পরা ব্যক্তি হলেন শোয়েব খান। তিনি নওয়াপাড়া গ্রুপের কর্মকর্তা ও গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সাইদুর রহমানের আত্মীয়। আর সাদা শার্ট পরা ব্যক্তি হলেন সোহাগ। তিনি ওই প্রতিষ্ঠানের কর্মচারী।

ওবায়দুল বলেন, নওয়াপাড়া গ্রুপের দুজন মালিক। তাঁদের একজনের দূরসম্পর্কের শ্যালক শোয়েব খান কারণে-অকারণে তাঁদের ওপর নির্যাতন চালান। শারীরিক নির্যাতনের পাশাপাশি তাঁদের মানসিক নির্যাতন, এমনকি অর্থনৈতিকভাবেও শোষণ করেন। যেসব কর্মচারী প্রতিবাদ করেন, তাঁদের চাকরিচ্যুতির পাশাপাশি বেতন-পাওনা না মিটিয়ে বের করে দেওয়া হয়।

ওবায়দুল প্রথম আলোকে বলেন, ‘ঘটনাটি ২০২০ সালের ১ মার্চ সন্ধ্যার। তিনি ফরিদপুরে দায়িত্ব পালন করছিলেন। কথিত একটি চুরির ঘটনাকে পুঁজি করে তাঁকে সেখান থেকে নওয়াপাড়া কার্যালয়ে ডেকে আনা হয়। এরপর তাঁকে অফিসের মধ্যে বসিয়ে রাখা হয়। সেখানে রাকিবুল ইসলাম (২৬) ও বায়েজিদ শেখ (২২) নামের আরও দুই কর্মচারী ছিলেন। সন্ধ্যার পর কার্যালয়ের ভেতরে কর্মচারীদের খাওয়ার কক্ষে আমাকে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে কাঠের তৈরি শতাধিক কোদালের আছাড় ছিল। রাকিবুল ও বায়েজিদকে আমার দুই হাত ও দুই পা ধরতে নির্দেশ দেন শোয়েব খান। তাঁরা আমাকে সেভাবে ধরলে সোহাগ মোটা লাঠি দিয়ে আমার পশ্চাদ্দেশে বেদম পেটান। পরে রাকিবুল ও বায়েজিদকে একইভাবে পর্যায়ক্রমে পেটানো হয়। আমাকেও তাঁদের হাত-পা ধরতে বাধ্য করা হয়। নির্যাতনের পর আমাদের ওই কক্ষের মধ্যে ফেলে রাখা হয়। পরদিন ২ মার্চ সকালে আমাদের পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া হয়। এরপর পুলিশ ফরিদপুরের কোতোয়ালি থানায় আমাদের নিয়ে যায়। সেখানে আমাদের বিরুদ্ধে গম চুরির অভিযোগে মামলা দেওয়া হয়। আড়াই মাস কারাগারে থাকার পর জামিনে মুক্তি পেয়ে বাড়ি আসি।’

মারধরের শিকার রাকিবুল প্রথম আলোকে বলেন, ‘শোয়েব খান একই কার্যালয়ের কর্মী ও তাঁর অনুগত সোহাগ, ইমরান, অনুপ ও ইমদাদের সহায়তায় আমাদের এভাবে অমানবিকভাবে পেটান। কথিত একটি চুরির ঘটনাকে পুঁজি করে আমাদের পেটানো হয়। ফরিদপুরে গম চুরির কথিত একটি মামলায় আমাদের দায়ী করে সম্পূর্ণ বিনা কারণে মারধর করা হয়। ঘটনার পরপরই আমাদের চাকরিচ্যুত করা হয়। নওয়াপাড়া বাজারের প্রধান সড়কে নওয়াপাড়া গ্রুপের কার্যালয়। এ কার্যালয়ের ডাইনিংয়ে কর্মচারীদের মারধরের জন্য টর্চার সেল রয়েছে। সেখানে শতাধিক লাঠি (বেলচার জন্য নির্মিত কাঠের বাঁট) রাখা ছিল। এসব লাঠি দিয়ে মারধর করা হয় কর্মীদের।’

নির্যাতনের শিকার আরেক তরুণ অভয়নগরের আমডাঙ্গা গ্রামের নছিমন (ইঞ্জিনচালিত ভটভটি) চালক মো. আমিন উদ্দিন (২৪) বলেন, ‘আমি নছিমনে নওয়াপাড়া গ্রুপের মালামাল টানি। চলতি বছরের ৯ ফেব্রুয়ারি নছিমনে করে ইট নিয়ে যাই। আমাকে ওখানকার লোকজন ১০ থেকে ১৫ খানা ইট দেয়। এ ঘটনায় চুরির অভিযোগ এনে আমাকে বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে নওয়াপাড়া গ্রুপের টর্চার সেলে তাঁরা আটকে রাখে। রাতের বেলায় নওয়াপাড়া গ্রুপের কর্মকর্তা শোয়েব খান কোদালের আছাড় দিয়ে আমাকে মারেন।’

এ ব্যাপারে মন্তব্য জানার জন্য শোয়েব খানের দুটি মুঠোফোন নম্বরে একাধিকবার যোগাযোগ করা হলেও তা বন্ধ পাওয়া যায়। আর নওয়াপাড়া গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সাইদুর রহমান বর্তমানে দেশের বাইরে থাকায় তাঁর সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি।

যশোর জেলা পুলিশের মুখপাত্র ও গোয়েন্দা শাখার (ডিবি) ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) রূপন কুমার সরকার বলেন, ঘটনাটি তদন্ত করার জন্য ডিবির একজন কর্মকর্তাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তদন্তের পর এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।