‘আগুনে সব শ্যাষ আমার, দুধের বাচ্চা দুইডা লইয়া কই ঠাঁই লমু?’

পুড়ে যাওয়া ঘরটির ভেতরে গিয়ে কিছু পান কি না খুঁজে দেখছেন নূপুর বেগম। বুধবার দুপুরে মাদারীপুর কালকিনি উপজেলার আলীনগর ইউনিয়নের কালিনগরে
ছবি: প্রথম আলো

মাদারীপুরের কালকিনিতে কৃষক লীগ নেতা মানিক সরদারকে কুপিয়ে হত্যার ঘটনায় তাঁর সমর্থকেরা আলীনগর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সাবেক চেয়ারম্যান হাফিজুর রহমানের বাড়িতে হামলা ও লুটপাট চালান। পরে পেট্রল ঢেলে হাফিজুরের ঘরসহ ১২টি ঘর ও ১টি ইটভাটায় আগুন ধরিয়ে দেন। আগুনে পুড়ে গেছে কয়েকজন নিরীহ ব্যক্তির ঘর। তাঁদের একজন ভ্যানচালক রাজু ব্যাপারী (৩৫)। স্ত্রী ও ছোট্ট দুই সন্তানকে নিয়ে রাজু থাকতেন সাবেক চেয়ারম্যান হাফিজুর রহমান সরদারের বাড়ির সামনে একটি টিনশেড ঘরে। গতকাল মঙ্গলবার রাতে তাঁর ঘরটিও আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হয়।

মাথা গোঁজার একমাত্র স্থানটি হারিয়ে দিশেহারা রাজু ও নূপুর দম্পতি। আজ বুধবার দুপুরে পুড়ে ছাই হয়ে যাওয়া ঘরটি সামনে গিয়ে দেখা যায়, ঘরের সামনে ছোট্ট দুই সন্তানকে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন রাজুর স্ত্রী নূপুর বেগম। কিছুক্ষণ পরপর তিনি তাঁর শিশুপুত্রকে কোলে নিয়ে পোড়া ঘরটির ভেতরে কিছু পাওয়ার আশায় খুঁজে দেখছেন। কিন্তু পুরো ঘরটি যে আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে, সেটি হয়তো তিনি দেখেও বুঝতে পারছেন না।

আরও পড়ুন

নূপুরের এক ছেলে ও এক মেয়ে। ছেলে রমজানের বয়স এক বছর ও মেয়ে হুমায়ারার বয়স দুই বছর। ছোট্ট এই দুই সন্তানকে নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়া মা নূপুর বেগম প্রথম আলোকে বলেন, ‘ঘরে যা কিছু ছিল সব মালামাল শ্যাষ। আগুনে পুড়ে সব শ্যাষ হইয়া গেছে। দুধের বাচ্চা দুইডার খাওনও পুইড়া ছাই। বাচ্চাগো সব পোশাক-আশাক ওরা পোড়াইয়া দিছে। এহন দুধের বাচ্চা দুইডা লইয়া আমি কই ঠাঁই লমু?’

আমরা তো কোনো দোষ করি নাই। আমার সঙ্গে কারও কোনো বিরোধও নাই। নির্বাচনে দুইটা পক্ষ থাকায় কাউরেই ভোট দিতে কেন্দ্রে পর্যন্ত যাই নাই। তবু কেন আমাগো ওপর জুলুম হবে?
রাজু ব্যাপারী, ভ্যানচালক

আলীনগর ইউপির সাবেক চেয়ারম্যান হাফিজুর রহমানের বাড়ির ঠিক সামনে তাঁর ভাই শিক্ষক কিরণ সরদারের বাড়ি। তাঁর বাড়ির তিনটি ঘর আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। কিরণ সরদারের বাড়ির পাশে ছোট একটি টিনশেড ঘরে রাজু-নূপুর দম্পতি বসবাস করেন।

ভ্যানচালক রাজু প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা তো কোনো দোষ করি নাই। আমার সঙ্গে কারও কোনো বিরোধও নাই। নির্বাচনে দুইটা পক্ষ থাকায় কাউরেই ভোট দিতে কেন্দ্রে পর্যন্ত যাই নাই। তবু কেন আমাগো ওপর জুলুম হবে? পেট্রল ঢাইলা ওরা আমার ঘরডা ছাই করে দিছে। ঘরের সবকিছু আঙ্গার হয়ে গেছে। কিছু আস্ত নাই যা দিয়া উঠে দাঁড়ামু। স্ত্রী ও ছোট ছোট দুই বাচ্চা লইয়া মরণ ছাড়া গতি নাই।’

আরও পড়ুন

রাজু জানান, গতকাল সন্ধ্যার পরপরেই যখন তাণ্ডবলীলা শুরু হয়, তখন পরিবারের সবাইকে নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে আশ্রয় নেন দূরে এক আত্মীয়বাড়িতে। সকালে খবর পান সাবেক চেয়ারম্যান মিলন সরদারের ঘরের সঙ্গে তাঁর ছোট্ট ঘরটিও আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দিয়েছে।

নূপুরের বোন মাহিনূর বেগম বলেন, ‘বোনের সাজানো ছোট্ট সংসারটা পুড়ে ছাই। ঘরে বাচ্চা দুইডার খাবার পর্যন্ত নাই। সব পুড়ে গেছে। যারা ওদের এত বড় ক্ষতি করল আমি তাদের বিচার চাই।’

মঙ্গলবার রাতে ১২টি ঘর ও ১টি ইটভাটায় অগ্নিসংযোগ, লুটপাটের ঘটনায় কাউকে আটক করতে পারেনি পুলিশ। এ ঘটনায় পুরো ইউনিয়নে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। থমথমে পরিবেশ বিরাজ করায় মোতায়েন রয়েছে অতিরিক্ত পুলিশ। আগের মতো সাধারণ মানুষের সমাগম নেই এলাকায়।

এ বিষয়ে কালকিনি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ইশতিয়াক আশফাক আজ সন্ধ্যায় প্রথম আলোকে বলেন, ‘মঙ্গলবার কয়েকটি ঘরে অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটলেও ক্ষতিগ্রস্ত কেউ এখন পর্যন্ত আমাদের কাছ লিখিত কোনো অভিযোগ দেননি। তাই কাউকে আটক করা সম্ভব হয়নি। যদি কেউ অভিযোগ দেন, তাহলে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তবে এলাকায় অপ্রীতিকর কোনো ঘটনা যেন ফের না ঘটে, এর জন্য অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন রাখা হয়েছে।’