নেত্রকোনায় গত ৮ মাসে অন্তত ৭২ জন শিশু পানিতে ডুবে মারা গেছে। তাদের মধ্যে গত চার মাসেই মারা গেছে ৪৮ জন। যেসব শিশু মারা গেছে, তাদের বয়স ২ থেকে ৯ বছরের মধ্যে।

গত ১ জানুয়ারি থেকে গতকাল বৃহস্পতিবার পর্যন্ত প্রথম আলোর সংবাদ ও পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে থাকা হিসাব বিশ্লেষণ করে এ তথ্য পাওয়া গেছে। জাতিসংঘের শিশু তহবিলের (ইউনিসেফ) ময়মনসিংহ ও ঢাকা অঞ্চলের কর্মসূচি কর্মকর্তা মো. আমান উল্লাহ বলেন, শিশুদের সাঁতার না জানা, তাৎক্ষণিক প্রাথমিক চিকিৎসাজ্ঞান না থাকা, সচেতনতার অভাবে এ ধরনের দুর্ঘটনার ঘটনা ঘটছে।

সর্বশেষ গতকাল দুপুরে কলমাকান্দায় পুকুরের পানিতে ডুবে সাইম নামের আড়াই বছরের এক শিশুর মৃত্যু হয়। সাইম তেলিগাঁও এলাকার মো. সাঈদ মিয়ার ছেলে। থানা- পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, বেলা ১১টার দিকে সাইম বাড়ির উঠানে খেলছিল। কিছুক্ষণ পর তাকে না পেয়ে পরিবারের লোকজন খোঁজাখুঁজি শুরু করেন। বেলা সাড়ে ১১টার দিকে বাড়ির সামনের পুকুরে স্থানীয় ব্যক্তিরা শিশুটির লাশ পানিতে ভাসতে দেখে উদ্ধার করেন। পরে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে গেলে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।

কলমাকান্দা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. আবদুল আহাদ খান বলেন, আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে শিশুটির লাশ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। থানায় এ নিয়ে একটি অপমৃত্যু মামলা হয়েছে।

বিভিন্ন তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, জুন ও আগস্ট মাসে জেলায় পানিতে ডুবে শিশু মৃত্যুর হার সবচেয়ে বেশি। ওই দুই মাসে ২৪ জন মারা যায়। উপজেলাভিত্তিক হিসাবে কলমাকান্দা ও দুর্গাপুরে মৃত্যুর সংখ্যা বেশি। গত চার মাসে কলমাকান্দায় ১৫ জন ও দুর্গাপুরে ৯ জন শিশুর মৃত্যু হয়। এ ছাড়া খালিয়াজুরি ও মদনে ছয়জন করে এবং আটপাড়া, মোহনগঞ্জ ও সদর উপজেলায় চারজন করে রয়েছে।

কলমাকান্দার স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা মো. আবদুল্লাহ আল মামুন জানান, হাসপাতালে আনার আগেই বেশির ভাগ সময় শিশুদের মৃত্যু হয়ে যায়। তিনি মনে করেন, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো কেউ ডুবে গেলে তাকে উদ্ধারের পরপর তার শ্বাসপ্রশ্বাস চালু করার যেসব প্রাথমিক উদ্যোগ আছে, সেগুলো মানুষকে শেখানো। বিভিন্ন সভা–সেমিনারে উপজেলা স্বাস্থ্য বিভাগের পক্ষ থেকে তা করা হচ্ছে।

তথ্য বিশ্লেষণ করে আরও জানা যায়, যেসব শিশুর পানিতে ডুবে মৃত্যু হয়েছে, তাদের বয়স ২ থেকে ৯ বছরের মধ্যে। বেশির ভাগ শিশুই বাড়ির সামনে, পেছনে বা পাশের পুকুর, ডোবায় (ছোট জলাশয়) ডুবে মারা গেছে। এসব মৃত্যুর ঘটনা সকাল আটটা থেকে বিকেল চারটার মধ্যে বেশি হয়। সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত ঘরের লোকজন কাজে ব্যস্ত থাকেন। তখন তাঁরা শিশুরা কোথায় খেলছে, অনেক সময় খেয়াল করেন না। আর দুপুর থেকে বিকেল পর্যন্ত সময়ে যখন পরিবারের সদস্যরা বিশ্রাম করেন, তখন শিশুরা খেলতে বের হয় আর দুর্ঘটনার শিকার হয়। মারা যাওয়া শিশুদের মধ্যে দরিদ্র পরিবারের শিশু বেশি।

সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) নেত্রকোনা কমিটির সভাপতি শ্যামলেন্দু পাল বলেন, জেলায় গত ৮ মাসে ৭২ জনের পানিতে ডুবে মৃত্যুর বিষয়টি উদ্বেগজনক। কমিউনিটি সচেতনতা ছাড়া কোনো পথ নেই। এ নিয়ে স্থানীয় প্রশাসন ও স্বাস্থ্য বিভাগের পক্ষ থেকে বিভিন্ন ধরনের সভা–সমাবেশ ও প্রচার–প্রচারণা প্রয়োজন।

পুলিশ সুপার মো. আকবর আলী মুন্সী বলেন, প্রতিটি দুর্ঘটনার পর পুলিশ সেখানে যান এবং সচেতনতা বাড়াতে তারা এলাকাবাসীর সঙ্গে কথা বলে।

জেলা প্রশাসক কাজী মো. আবদুর রহমান বলেন, পানিতে ডুবে এত শিশুর মৃত্যুর বিষয়টি তাঁদের ভাবিয়ে তুলছে। প্রশাসনের পক্ষ থেকে
এ নিয়ে আরও গণসচেতনা তৈরি করার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।