‘এই নমুনা সংগ্রহ মানুষকে সান্ত্বনা দিতে, নাকি নিখোঁজ মানুষগুলোর সন্ধান করতে, তা বুঝতে পারছি না। যদি আগুনে পুড়ে কয়লা হয়ে থাকে আমার পরিবারের সদস্যরা, তাহলে তো তাদের লাশ নদীতে ফেলে দেওয়া হয়েছে। যদি তা হয়, তাহলে কেন এই নমুনা নিয়ে আমাদের বিড়ম্বনা দেওয়া। আমরাও মানুষ, আমাদেরও মন আছে। যাঁরা স্বজন হারিয়েছেন, তাঁরা বোঝেন স্বজন হারানোর ব্যথা। ওরা তো আগুনে পুড়ে অঙ্গার হয়ে গেছে, এখন তো মিথ্যা সান্ত্বনা।’
বরগুনা সদর উপজেলার মোল্লাহোরা গ্রামের বাসিন্দা সুমন সরদার ডিএনএ পরীক্ষার জন্য নমুনা দিতে এসে বরগুনা জেনারেল হাসপাতালে আহাজারি করে এসব কথা বলেন। ঝালকাঠির সুগন্ধা নদীতে লঞ্চে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় তাঁর স্ত্রী তাসলিমা (৩০), দুই মেয়ে সুমাইয়া আক্তার (১৫) ও সুমনা আক্তার (১২) এখনো নিখোঁজ।
সুমন সরদার ঢাকার ডেমরা এলাকায় অটোরিকশা চালিয়ে সংসার চালাতেন। তিনি বলেন, ‘ছোট সংসার। তবে খুব ভালোই কেটে যেত আমাদের দিনগুলো। সব সময় চেষ্টা করছি নিজে যতই পরিশ্রম হোক না কেন, দুই মেয়েকে শিক্ষিত করে তুলব। ওই দিন আমার স্ত্রী ও দুই মেয়ের সঙ্গে চাচাতো ভাই ও চাচি ছিলেন। চাচাতো ভাই রাত তিনটার দিকে ফোন দিয়ে বলে, “আমি তো আমার ভাইঝিগো বাঁচাতে পারলাম না।”
রাতে আমি এলাকার মোটরসাইকেলে বরিশাল হয়ে ঝালকাঠি দুর্ঘটনার স্থানে চলে যাই। এদিক-ওদিক ছোটাছুটি করি। তারা বেঁচে আছে কি না, সেটা নিশ্চিত হওয়ার জন্য বিভিন্ন লাশ তিন থেকে চারবার করে ওলট-পালট করে দেখার চেষ্টা করি কোনটা আমার স্ত্রী ও মেয়েদের। সকাল হওয়ার পর আমি ইঞ্জিনচালিত ট্রলার ভাড়া করে নদীতে তাদের খুঁজতে থাকি। পরিবারের তিন সদস্যের মধ্যে এখন পর্যন্ত একজনেরও সন্ধান পাইনি।’
‘তাদের লাশ পর্যন্ত এখনো দেখতে পারিনি। তারা বেঁচে আছে, নাকি মারা গেছে?’ সুমন সরদার কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘আমার সব শেষ, এখন আমার বেঁচে থেকে কী হবে। আমার মেয়ে আমাকে বলছিল, “বাবা, কাঠ দিয়ে ঘর তুলবা না, বাড়িতে বিল্ডিং রুম করবা, ভেতরে জন্য বাথরুম থাকবে।” আজ বিল্ডিং করছি, কিন্তু আমার মেয়ে নেই। আমার খুব কষ্ট হচ্ছে মেয়েদের স্বপ্নের কথা মনে করে। তাদের একটিমাত্র ইচ্ছে ছিল বাড়ির ভেতরে বিল্ডিং, তার মধ্যে পাকা বাথরুম। মেয়েদের ইচ্ছে পূরণ করতে পারলাম না।’
লঞ্চ দুর্ঘটনায় নিখোঁজ বরগুনার তালতলী উপজেলা জুনাইদের (৭) বাবা বরগুনা জেনারেল হাসপাতালে এসেছেন নিখোঁজ ছেলেকে খুঁজে পেতে ডিএনএ পরীক্ষার জন্য নমুনা দিতে। তিনি বলেন, ‘আমার ছেলেকে লঞ্চে উঠিয়ে দিয়ে নামার পর আবার আমি ছেলের কাছে আসি। লঞ্চে আমার স্ত্রী, শাশুড়ি ও আমার ছেলে ছিল। ঘটনা দিন রাত তিনটার দিকে আমার স্ত্রী ফোন করে বলে, “আমাদের জন্য দোয়া করো, লঞ্চে আগুন লেগেছে।” তখন আমি তাকে বলছিলাম, “চিন্তা কোরো না আগুন নিভে যাবে।” পরে আমি তাকে কল দিলে সে আমাকে বলে, লঞ্চে আগুনের কারণে ডাকচিৎকার করছে সবাই। রাত ৪টার দিকে আমার স্ত্রীকে ফোন করলে সে জানায়, জুনাইদ ও আমার শাশুড়িকে পাওয়া যাচ্ছে না। তারা যদি লঞ্চে পুড়ে মারা যায়, তাহলে তো ফায়ার সার্ভিসের লোকজন নদীতে ফেলে দিয়েছেন। তাহলে এই নমুনা দিয়ে কার সন্ধান করবে। এটা তো লোকদেখানো বিষয়।’
মা রুনা বেগম ও ছোট বোন রুশনি আক্তারের লাশ খুঁজে পেতে সোমবার দুপুরে নমুনা দিতে এসেছেন আহত জিসান শিকদার। তাঁর বাড়ি বেতাগীর করুনা গ্রামে। তিনি বলেন, ‘আমার নানু অসুস্থ থাকায় আমরা পরিবারসহ লঞ্চে করে গ্রামের বাড়ির উদ্দেশে সদরঘাট থেকে রওনা করি। আমরা সবাই ঘুমে ছিলাম, হঠাৎ করে লঞ্চে আগুন লাগে। তাড়াহুড়ো করে আমার আম্মুকে নিয়ে আমি ছাদে চলে যাই। আম্মুকে নিয়ে নিচে নামার চেষ্টা করেছি, কিন্তু পারিনি। আমি লঞ্চের সামনের অংশে গিয়ে নদীতে ঝাঁপ দিয়ে প্রায় এক ঘণ্টা নদীতে সাঁতার কেটে নিজের জীবন রক্ষা করতে পেরেছি।’