৬০ বছর আগের এক সন্ধ্যা। সুনামগঞ্জের লোকাল বোর্ডের চেয়ারম্যানের কক্ষ। সেখানে এক মহৎ উদ্দেশ্যে মিলিত হয়েছেন শহরের গুণীজনেরা। ওই বৈঠকেই সিদ্ধান্ত হয় একটি গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠার। সেই থেকে যাত্রা শুরু, আজও শহরে আলো ছড়াচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি।
শহীদ মুক্তিযোদ্ধা জগৎজ্যোতি পাবলিক লাইব্রেরির পুরোনো নথিপত্র ঘেঁটে জানা যায় এই তথ্য। দীর্ঘ ৬০ বছরের যাত্রায় শহরের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক নানা ঘটনার সাক্ষী এই ‘বাতিঘর’। শহরের কত শত মানুষের সুখস্মৃতি জড়িয়ে আছে এই গ্রন্থাগারে। একসময়ের টিনশেড ভবন থেকে এখন সুরম্য দ্বিতল ভবন হয়েছে। প্রায় ২০ হাজার বইয়ের বিশাল ভান্ডার আছে এখানে।
নথিপত্র থেকে জানা যায়, ১৯৫৯ সালের ১৭ জুনের সেই সন্ধ্যার বৈঠকে সভাপতি ছিলেন তৎকালীন মহকুমা প্রশাসক বি আর নিজাম। তাঁকেই সভাপতি ও শহরের আরেক গুণীজন মনোরঞ্জন চৌধুরীকে সাধারণ সম্পাদক করে পাঠাগারটির যাত্রা শুরু। সেদিনের বৈঠকে আরও উপস্থিত ছিলেন মফিজ চৌধুরী, আবু হানিফা আহমদ (নবাব মিয়া), মনোরঞ্জন চৌধুরী, এম এইচ চৌধুরী, নাজির উদ্দিন, হেমচন্দ্র চৌধুরী, এ এফ এম আবদুল আলী, এ কে সরকার, সুরেশ চন্দ্র আচার্য্য, এম হোসাইন, দেওয়ান আনোয়ার রাজা চৌধুরী, আফাজ উদ্দিন আহমদ, টি হোসাইন, এ গণি, অক্ষয় কুমার দাস, লতিফ উদ্দিন চৌধুরী।
শুরুতে এটির নাম ছিল ‘সুনামগঞ্জ পাবলিক লাইব্রেরি’। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর নামকরণ করা হয় একজন বীর মুক্তিযোদ্ধার নামে, ‘শহীদ মুক্তিযোদ্ধা জগৎজ্যোতি পাঠাগার’। তবে সঙ্গে ব্র্যাকেটে ‘সুনামগঞ্জ পাবলিক লাইব্রেরি’ কথাটি যুক্ত ছিল। সর্বশেষ নাম হয়েছে ‘শহীদ মুক্তিযোদ্ধা জগৎজ্যোতি পাবলিক লাইব্রেরি’। সুনামগঞ্জ সরকারি কলেজের তৎকালীন ছাত্র ও ছাত্রনেতা জগৎজ্যোতি ছিলেন গেরিলাযোদ্ধা।
শহরের কেন্দ্রস্থল আলফাত স্কয়ার থেকে সামান্য পূর্ব দিকে ডি এস রোডের উত্তর পাশে এটির অবস্থান। লাইব্রেরির নিচতলায় বিশাল পাঠকক্ষ, অফিসকক্ষ ও সাধারণ সম্পাদকের বসার আরেকটি কক্ষ আছে। দোতলায় শীতাতপনিয়ন্ত্রিত মিলনায়তন। পূর্ব পাশে রয়েছে গ্রন্থাগারের নিজস্ব একটি বিপণিবিতান।
প্রতিষ্ঠার সঙ্গে জড়িত বিশিষ্টজনেরাই প্রথমে গ্রন্থাগারে বই দেন। একই সঙ্গে নানাভাবে তাঁরা বই সংগ্রহ করেন এবং মানুষজনকে এখানে এসে বই পড়তে উৎসাহিত করেন। একপর্যায়ে শহরের স্কুল ও কলেজের শিক্ষার্থীরাও গ্রন্থাগারে আসতে থাকেন। এখনো শান্ত-নিরিবিলি পরিবেশে শহরের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার লোকজন প্রতিদিন বিকেলে বই, পত্রপত্রিকা পড়তে আসেন। আবার চাইলে বাড়িতে নিয়েও পড়া যায় পছন্দের বই। লাইব্রেরিতে নিয়মিত বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা, সুধী সমাবেশ, রবীন্দ্র ও নজরুলজয়ন্তী উদ্যাপিত হয়। ১৯৮৬ সালে গ্রন্থাগারের পাকা ভবন হয়। ২০০২ সালে দ্বিতীয় তলা নির্মাণ করা হয়।
গ্রন্থাগারের ৫৪টি আলমারিতে সাজিয়ে রাখা আছে বই। এখানে স্নাতক সম্মান বর্ষের শিক্ষার্থীদের পাঠ্যবইও রাখা হয়েছে। গ্রন্থাগারের ওয়েবসাইটে এ-সম্পর্কিত যাবতীয় তথ্য দেওয়া আছে।
গ্রন্থাগারে এখন ১৪টি জাতীয় দৈনিক পত্রিকাসহ সুনামগঞ্জের সব স্থানীয় দৈনিক পত্রিকা রাখা হয়। পাশাপাশি রাখা হয় চারটি ম্যাগাজিন। প্রতিদিন বেলা তিনটা থেকে রাত নয়টা পর্যন্ত পাঠকক্ষ খোলা থাকে। গ্রন্থাগারে বর্তমানে দাতা, আজীবন, সাধারণ ও শিক্ষার্থী সদস্য আছেন ৭১৮ জন। ২০১৪ সাল থেকে গ্রন্থাগার পরিচালনা কমিটির দ্বিবার্ষিক নির্বাচন হচ্ছে। পদাধিকার বলে জেলা প্রশাসক এই কমিটির সভাপতি হন। গ্রন্থাগারের বর্তমান সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছেন আইনজীবী সালেহ আহমদ। তিনি সদস্যদের সরাসরি ভোটে নির্বাচিত। গ্রন্থাগারের কর্মী আছেন চারজন।
সুনামগঞ্জের ইতিহাস ও ঐতিহ্য গ্রন্থের লেখক আবু আলী সাজ্জাদ হোসাইন তাঁর এক লেখায় উল্লেখ করেছেন, গ্রন্থাগার পরিচালনার জন্য ১৯৬২ সালে একটি গঠনতন্ত্র প্রণয়ন করা হয়।
গ্রন্থাগারের বর্তমান সাধারণ সম্পাদক সালেহ আহমদ বলেন, ‘তথ্যপ্রযুক্তির এই যুগে নানা সহজ মাধ্যম থাকার পরও মানুষ লাইব্রেরিতে বই, পত্রপত্রিকা পড়তে আসেন, বাড়িতে বই নিয়ে পড়েন, এটা আমাদের আশা জাগায়। বিশেষ করে স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা যখন এখানে এসে বই পড়ে, সময় কাটায়, সেটা দেখে খুব ভালো লাগে।’