আশ্রয়কেন্দ্রে ঈদ কাটবে ৭ হাজার মানুষের

আজ শনিবার সুনামগঞ্জ পৌর শহরের বালিকা উচ্চবিদ্যালয় আশ্রয়কেন্দ্রে
ছবি: প্রথম আলো

সুনামগঞ্জে বন্যায় হাজার হাজার মানুষের ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে। এখন বন্যার পানি নামায় অনেকেই বাড়িঘরে ফিরেছে। আবার অনেকের ঘরে এখনো পানি আছে। কারও কারও বসতঘর সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত হওয়ায় এখনো বাড়ি ফিরতে পারছে না তারা। এ অবস্থায় আশ্রয়কেন্দ্রেই ঈদ কাটবে তাদের।

সুনামগঞ্জ পৌর শহরের নতুন হাসননগর এলাকার বাসিন্দা মছরব আলী (৫০) পরিবারের আটজন মানুষ নিয়ে ২৮ দিন ধরে আছেন শহরের বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ে। এর মধ্যে স্ত্রী, চার ছেলে, দুই মেয়ে আছে। তিনি বলেন, বন্যার পানিতে ঘর ভেসে গেছে। ভিটা খালি পড়ে আছে। এখন যে ঘর বানাবেন, সেই সামর্থ্য নেই। তাই ভিটায় ফিরতে পারছেন না। কবে ফিরবেন, সেটিও নিশ্চিত করে বলতে পারছেন না।

মছরব আলীর স্ত্রী শাহেদা বেগম (৪২) বলেন, ‘ঘর নাই, দুয়ার নাই। আমার যাইতাম কোয়াই। আমরার আরবার ঈদ কিতা। যেলা আছি অউলাই যাইব।’

শুধু এই একটি পরিবার নয়, বন্যায় বিপাকে পড়া জেলার ৭৩টি আশ্রয়কেন্দ্রে এবার ঈদ কাটবে সাত হাজার মানুষের। বন্যা শুরুর পর সরকারি হিসাবে ৬২০টি আশ্রয়কেন্দ্রে ১ লাখ ৬০ হাজার মানুষ আশ্রয় নিয়েছিল। বাড়িঘর থেকে পানি নামায় অনেকে ফিরে গেছে। এখন যারা আছে, তাদের বেশির ভাগেরই ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে, যে কারণে তারা ফিরতে পারছে না। শুধু আশ্রয়কেন্দ্র নয়, এ বাইরে জেলার বিভিন্ন স্থানে সড়কের পাশে আশ্রয় নেওয়া আরও দুই শতাধিক পরিবারের ঈদও একইভাবে কাটবে।

সুনামগঞ্জ বালিকা উচ্চবিদ্যালয় মছরবের পরিবার ছাড়া আরও পাঁচটি পরিবার আছে এখনো। নতুন হাসননগর গ্রামের বাসিন্দা শামসুল আলম (৪৫) বলেন, ‘ঘর থেকে পানি নামছে না। রান্নাঘর একেবারে ভেঙে গেছে। মেঝেতে থাকা দায়। বাড়ি ফিরতে আরও কয়েক দিন লাগবে। ভাবছি, ঈদের পরে যাইমু।’ একই এলাকার রিকশাশ্রমিক জুবের আহমদ (২৭) বলেন, ‘ঘর সংস্কারের কোনো টাকাপয়সা নাই। তাই যেতে পারছি না। এ জন্য ঈদ করতে হবে স্কুলেই।’ ঈদের প্রস্তুতি সম্পর্কে জানতে চাইলে শাহানারা বেগম (৫২) নামের এক নারী বলেন, ‘মাইনষের সায়-সাহায্য দিয়া চলরাম। আমরার ঈদ নাই। বন্যায় সবতা শেষ। বড় কষ্টে আছি।’

সদর উপজেলার জানিগাঁও গ্রামের বাসিন্দা ওয়াছির আলী (৪৫) বলেন, ঘরবাড়ি তলিয়ে যাওয়ায় সড়কের পাশে খুপরি তুলে পরিবার, গরু-ছাগলসহ আশ্রয় নিয়েছিলেন। ধান নষ্ট হয়েছে ৪০ মণের মতো। ঘরবাড়ির ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। ওয়াছির আলী বলেন, ‘এখন কীভাবে ঘরের কাজ করমু, কীভাবে খাইমু, এই নিয়ে চিন্তায় ঘুম নাই। ইলা বিপদে কোনো দিন পড়ছি না। ঘর না ঠিক করা পর্যন্ত ত সড়কেই থাকত অইব।’

হাওর বাঁচাও আন্দোলন সংগঠনের জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল হক বলেছেন, তিন মাস ধরে হাওর এলাকার মানুষের ওপর দিয়ে ঝড় যাচ্ছে। মানুষের ঘরবাড়ি নেই, কাজ নেই, খাবারের সংকট চলছে, সম্পদের বিপুল ক্ষতি হচ্ছে। অনেক মানুষ এখনো বাড়িঘরে ফিরতে পারছে না। এবার হাওর এলাকায় ঈদের আমেজ-আনন্দ কম।

সুনামগঞ্জ পৌরসভার মেয়র নাদের বখত বলেন, যাদের বাড়িঘর সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত হয়েছে, আশ্রয়কেন্দ্রে তাদের থাকতে তো কোনো বাধা নেই। কিন্তু আশ্রয়কেন্দ্রে থাকলে ত্রাণ বেশি পাবে, কেউ কেউ এটা মনে করে আছে।

জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা মোহাম্মদ শফিকুল ইসলাম বলেন, বন্যার অনেক উন্নতি হয়েছে। বাড়িঘর, রাস্তাঘাট থেকে পানি নেমে গেছে। তবে এখনো হাজার সাতেক মানুষ আশ্রয়কেন্দ্রে আছে। তাদের কারও কারও বসতঘরের ক্ষতি হয়েছে।

সুনামগঞ্জে ১৬ জুন থেকে বন্যা ভয়াবহ রূপ নেয়। জেলাজুড়ে এই বন্যায় মানুষের বাড়িঘর, রাস্তাঘাট, ধান, মাছের ক্ষতি হয়। পৌর শহরে চার থেকে সাত ফুট পানি ছিল টানা চার দিন। এ সময় এই জেলা সারা দেশ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। মুঠোফোনের নেটওয়ার্ক ছিল বন্ধ। হাজার হাজার মানুষ ঘরবাড়ি ছেড়ে আশ্রয়কেন্দ্রসহ বিভিন্ন জায়গায় ঠাঁই নেয়। সরকারি হিসাবেই বন্যায় ৩০ লাখ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। মানুষের ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে প্রায় ৫০ হাজার। ২৫ হাজার পুকুরের মাছ ভেসে গেছে। সড়ক ক্ষতিগ্রস্ত ২ হাজার ২০০ কিলোমিটার।