‘ইঞ্জিন চুলায়’ বিপন্ন রোহিঙ্গা জীবন

কক্সবাজারের উখিয়ার একটি ক্যাম্পের বাজারে বিনামূল্যে পাওয়া গ্যাস সিলিন্ডার বিক্রি করতে যাচ্ছেন এক রোহিঙ্গা। বুধবার সকালে
ছবি: প্রথম আলো

কক্সবাজারের রোহিঙ্গা আশ্রয়শিবিরে এখন নতুন আতঙ্কের নাম ‘ইঞ্জিন চুলা’। বনের কাঠের ওপর নির্ভরশীলতা কমাতে উখিয়া ও টেকনাফের আশ্রয়শিবিরগুলোতে প্রতিটা রোহিঙ্গা পরিবারে সরবরাহ করা হচ্ছে তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাস (এলপিজি) সিলিন্ডার। এসব গ্যাসের চুলাকে রোহিঙ্গারা বলে ‘ইঞ্জিন চুলা’। এসব সিলিন্ডারের চুলা ব্যবহারে অভ্যস্ততা না থাকায় অহরহ ঘটছে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা। আর আগুন লাগলে সিলিন্ডার বিস্ফোরণের ঘটনাও ঘটছে। এসব ঘটনায় ইতিমধ্যে অনেকে গুরুতর আহত হয়েছেন।

পুলিশ, ফায়ার সার্ভিস ও রোহিঙ্গা নেতারা বলেন, বাংলাদেশে আসার আগে রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে গ্যাস সিলিন্ডার কখনো দেখেনি। বাংলাদেশে আসার এক বছর পর রোহিঙ্গারা গ্যাস সিলিন্ডার ব্যবহার শুরু করে। কিন্তু পরপর গ্যাসের চুলা থেকে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় রোহিঙ্গা শরণার্থীরা এই সিলিন্ডার ও চুলাকে ভয়ের চোখে দেখছে। অনেকে গ্যাসের সিলিন্ডার বিক্রি করে দিয়ে বাজার থেকে কাঠের লাকড়ি কিনে নিয়ে আসছে।

সর্বশেষ ৯ জানুয়ারি বিকেলে উখিয়ার শফিউল্লাহ কাটা আশ্রয়শিবিরে (ক্যাম্প-১৬) অগ্নিকাণ্ডে প্রায় ৫০০ বসতবাড়ি পুড়ে ছাই হয়েছে। গৃহহীন হয়েছে অন্তত ২ হাজার ২০০ রোহিঙ্গা। এই আগুনের সূত্রপাত হয়েছিল এক রোহিঙ্গা পরিবারের রান্নাঘরের গ্যাসের চুলা থেকেই।

বাংলাদেশে আসার আগে রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে গ্যাস সিলিন্ডার কখনো দেখেনি। বাংলাদেশে আসার এক বছর পর রোহিঙ্গারা গ্যাস সিলিন্ডার ব্যবহার শুরু করে।

গত বছরের ২২ মার্চ উখিয়ার বালুখালী আশ্রয়শিবিরে অগ্নিকাণ্ডে ১০ হাজারের বেশি রোহিঙ্গা বসতি পুড়ে ছাই হয়েছিল। ওই অগ্নিকাণ্ডে গৃহহীন হয়ে পড়ে অন্তত ৪৫ হাজার রোহিঙ্গা। আগুনে পুড়ে মারা যায় ৬ শিশুসহ অন্তত ১১ জন রোহিঙ্গা। আহত হয় চার শতাধিক।

গত তিন বছরে উখিয়া ও টেকনাফের ৫-৬টি আশ্রয়শিবিরে ১৭ বারের বেশি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে ১২টির বেশি অগ্নিকাণ্ড ঘটেছে গ্যাসের সিলিন্ডার থেকে।

কক্সবাজারের উখিয়ার একটি ক্যাম্পের বাজারে বিনামূল্যে পাওয়া গ্যাস সিলিন্ডার বিক্রি করতে যাচ্ছেন আরেক রোহিঙ্গা। বুধবার সকালে
ছবি: প্রথম আলো

এর সঙ্গে যোগ হয়েছে দুর্বৃত্তদের আগুন লাগিয়ে দেওয়ার ঘটনাও। সে ক্ষেত্রেও প্রচণ্ড শব্দে বিস্ফোরণ হচ্ছে গ্যাসের সিলিন্ডার। বালুখালী ক্যাম্পের কয়েকজন রোহিঙ্গা নেতা বলেন, রোহিঙ্গাদের শীর্ষ নেতা মুহিবুল্লাহকে হত্যার পর ক্যাম্পের অভ্যন্তরে ১০-১২টি রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী গ্রুপ মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে। আধিপত্য বিস্তারে গ্রুপগুলো একে অপরের বিরুদ্ধে উঠেপড়ে লেগেছে। এক দল আরেক দলকে কোণঠাসা করতে আগুন লাগিয়ে রোহিঙ্গা বসতিতে বড় ধরনের নাশকতা চালানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে বলে গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে। এ ব্যাপারে গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানো দরকার।

পুলিশ ও উপজেলা প্রশাসন সূত্রের তথ্য, ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পর মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে আট লাখ রোহিঙ্গা আশ্রয় নেওয়ার প্রথম এক বছরে উখিয়া ও টেকনাফের কোনো আশ্রয়শিবিরে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেনি। কারণ তখন রোহিঙ্গারা রান্নার কাজে ব্যবহার করত জ্বালানি কাঠ। জ্বালানি কাঠের জন্য আশপাশের বিপুল বনাঞ্চল তখন উজাড় হয়েছিল। বনের ওপর নির্ভরশীলতা কমাতে গত তিন বছর ধরে প্রতিটা রোহিঙ্গা পরিবারে একটি করে গ্যাস সিলিন্ডার সরবরাহ করেছে জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা ইউএনএইচসিআর, অভিবাসন সংস্থা আইওএমসহ বিভিন্ন বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা (এনজিও)। কিন্তু রোহিঙ্গারা গ্যাস সিলিন্ডার ব্যবহারে অনভিজ্ঞ এবং অভ্যস্ত না থাকায় বারবার অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটছে।

সরেজমিন চিত্র

আজ বুধবার সকাল ১০টা। আগুনে পুড়ে যাওয়া শফিউল্লাহ কাটা রোহিঙ্গা শিবিরের ধ্বংসস্তূপের উত্তর পাশে রোহিঙ্গা কামাল উদ্দিনের বসতবাড়ি। ৯ জানুয়ারির অগ্নিকাণ্ডে কামালের বসতবাড়ি পুড়ে ছাই হয়। এ সময় আগুনে পুড়ে গেছে রান্নার সরঞ্জামসহ একটি গ্যাস সিলিন্ডারও।

কামাল উদ্দিন (৪৪) বলেন, পাহাড়ের ঢালু ও সমতলে ত্রিপলের ছাউনি ও বাঁশের বেড়া দিয়ে তৈরি হয় একেকটি রোহিঙ্গা বসতি। বসতিগুলো একটার সঙ্গে আরেকটা লাগানো। ঘিঞ্জি ও ঘনবসতির কোনো একটি ঘরে আগুন ধরলে অন্য বসতিগুলো রক্ষার উপায় থাকে না। প্রতিটা ঘরে থাকা গ্যাস সিলিন্ডারগুলো বিকট শব্দে বিস্ফোরণ ঘটে। তখন রোহিঙ্গাদের জীবন বিপন্ন হয়।

কক্সবাজারের উখিয়ার বালুখালী রোহিঙ্গা ক্যাম্পের বাজারে বিক্রি হচ্ছে গ্যাস সিলিন্ডার
ছবি: প্রথম আলো

ধ্বংসস্তূপের পশ্চিম পাশে ত্রিপলে ছাউনির নিচে গ্যাসের চুল্লিতে ভাত রান্না করছেন রোহিঙ্গা গৃহবধূ আলমাস খাতুন (৩৪)। পাশে বসা তাঁর পাঁচ ও আট বছর বয়সী দুই সন্তান। আলমাস খাতুন বলেন, ৯ জানুয়ারির অগ্নিকাণ্ডে তাঁর রান্নাঘরের গ্যাস সিলিন্ডারসহ সবকিছু পুড়ে গেছে। বাজার থেকে আরেকটা গ্যাস সিলিন্ডার কিনে এনে রান্নার কাজ সামলাচ্ছেন। রান্নার সময় মনে ভয় থাকে, কখন ইঞ্জিন চুলা থেকে আগুন ধরে যায়।

শফিউল্লাহ কাটা আশ্রয়শিবির ছাড়াও উখিয়ার কুতুপালং, বালুখালী, মধুরছড়া, জুমশিয়া, লম্বাশিয়া ক্যাম্পের ঘরে ঘরে ব্যবহার হচ্ছে গ্যাসের সিলিন্ডার। ক্যাম্পগুলোর হাটবাজারে শত শত দোকানে বিক্রি হচ্ছে গ্যাসের সিলিন্ডার। কিছু রোহিঙ্গা বিনা মূল্যে পাওয়া গ্যাস সিলিন্ডার দোকানে ৭০০-৮০০ টাকায় বিক্রি করছে। সেসব সিলিন্ডার লোকে এক হাজার টাকার বেশি দামে কিনে বাসায় নিয়ে যাচ্ছেন।

জুমশিয়া ক্যাম্পের সি-ব্লকের গৃহবধূ সাজেদা বেগম (৩৭) বলেন, ভয় ও আতঙ্কে রোহিঙ্গাদের অনেকে ইঞ্জিন চুলা ব্যবহার করে না। তাই বিনা মূল্যে পাওয়া গ্যাস সিলিন্ডারগুলো বাজারে বিক্রি করে দিয়ে জ্বালানি কাঠ কিনে আনে।

প্রতিটা ক্যাম্পের হাটবাজার ও সড়কের পাশে জ্বালানি কাঠের স্তূপ চোখে পড়ে। রোহিঙ্গাদের নগদ টাকায় জ্বালানি কাঠ কিনতে দেখা যায়।

রোহিঙ্গা নেতা আরেফ উল্লাহ বলেন, গত বছরের ১৬ অক্টোবর রাতে টেকনাফের শালবন ক্যাম্পের এ-ব্লকের বাসিন্দা মোহাম্মদ ইউনুসের ঝুপড়ি ঘরে বিকট শব্দে গ্যাসের সিলিন্ডার বিস্ফোরণ ঘটে। এতে মোহাম্মদ ইউনুস (২৯), তাঁর স্ত্রী শওকত আরা বেগম (২২) ও ছেলে এহসান (২) গুরুতর আহত হন। ১৮ জুলাই উখিয়ার থাইংখালীর আশ্রয়শিবিরের বি-১৩ ব্লকে গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণ ঘটে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের তিনটি বসতি পুড়ে যায়। এ সময় ধলুবিবি (৪৫), জুলেখা বিবি (৫৫), অলী আহমদ (৪০), মো. রায়হান (৩০) ও আমান উল্লাহ (২৩) আহত হন। ওই সময় সেনাবাহিনীর সদস্যরা আগুন নিয়ন্ত্রণ না করলে পরিস্থিতি ভয়াবহ হতো।

টেকনাফের শালবন আশ্রয়শিবির ব্যবস্থাপনা কমিটির চেয়ারম্যান রমিদা বেগম বলেন, রান্নার সময় গ্যাসের সিলিন্ডার বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটছে এবং বিস্ফোরণ ঘটলে সহজে ত্রিপলের বসতিতে আগুন ধরে যায়। তা ছাড়া পাহাড়ি ঢালুতে ঘনবসতির ক্যাম্পগুলোতে আগুন ধরলে দ্রুত নেভানোর সুযোগ নেই। কারণ আগুন নেভানোর জন্য ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি ঘটনাস্থলে পৌঁছানোর রাস্তা নেই। ক্যাম্পের ভেতরের রাস্তাগুলো খুবই সরু। এখানে পায়ে হেঁটে যেতে হয়।

রোহিঙ্গা নেতারা বলছেন, বর্তমানে টেকনাফ ও উখিয়ার ৩৪টি আশ্রয়শিবিরে প্রায় ২ লাখ পরিবারে নিবন্ধিত রোহিঙ্গার সংখ্যা সাড়ে ১১ লাখ। এর মধ্যে অন্তত ৯৭ হাজার রোহিঙ্গা পরিবার বিনা মূল্যে গ্যাস সিলিন্ডার পেয়েছে। কিন্তু ব্যবহার সম্পর্কে ধারণা না থাকায় বারবার অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটছে।