সাক্ষাৎকার: মো. আনিছুর রহমান
ইলিশ এবার উদ্ভট আচরণ করছে
ড. মো. আনিছুর রহমান চাঁদপুরে অবস্থিত বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা। ৩৩ বছর ধরে তিনি মৎস্য গবেষণার সঙ্গে যুক্ত। বিশেষ করে ইলিশের জীবনচক্র, প্রজনন, ব্যবস্থাপনার আধুনিকায়নসহ নানা কাজে সরাসরি তিনি যুক্ত রয়েছেন। নানা উদ্যোগের কারণে দেশে ইলিশের উৎপাদন বাড়ছে। গত অর্থবছরে দেশে ৫ লাখ ৫০ হাজার মেট্রিক টন ইলিশ আহরিত হয়েছে, যা দেশের মোট মৎস্য উৎপাদনের প্রায় ১২ শতাংশ। বিশ্বজুড়ে ইলিশ উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন অনুকরণীয়। ২০১৭ সালে ইলিশ বাংলাদেশের ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পায়। পরের বছর বাংলাদেশের বিজ্ঞানীরা ইলিশের জীবনরহস্য উন্মোচন করেন। ইলিশের নানা কথা নিয়ে প্রথম আলোর মুখোমুখি হলেন এই বিজ্ঞানী।
প্রথম আলো: এবার নদ-নদীতে ইলিশের একরকম খরা ছিল। কয়েক দিন ধরে আবার আহরণ বেড়েছে। এমন অবস্থায় এবার ইলিশ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হবে?
আনিছুর রহমান: লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হবে কি না, সেটা এ মুহূর্তে বলা যাবে না। মৌসুম শেষ হলে বলা যাবে। এক সপ্তাহ আগেও কোথাও ইলিশ ছিল না। গত কয়েক দিনে পরিস্থিতি দ্রুতই বদলে গেছে। চাঁদপুর, পটুয়াখালীর মহিপুর ও আলীপুর, বরগুনার পাথরঘাটা, কক্সবাজার ও ভোলায় এখন প্রচুর ইলিশ আসছে। আবার কোনো কোনো স্থানে কিন্তু এখনো আসছে না। তবে আমি মনে করি, এখন দেশে ইলিশের মৌসুম একটি নয়, দুটি। আগস্ট থেকে অক্টোবর এবং ডিসেম্বর থেকে মার্চ।
প্রথম আলো: মৌসুমে ইলিশ ছিল না, হঠাৎ বেড়ে যাওয়ার পেছনে কী কারণ থাকতে পারে বলে মনে করছেন?
আনিছুর রহমান: ইলিশ এবার উদ্ভট আচরণ করছে। আসলে আমরাও তো প্রকৃতির সঙ্গে উদ্ভট আচরণ করছি। এর পেছনে মোটাদাগে যদি বলি, তা হলো অনুকূল পরিবেশের ঘাটতি। আর এ ঘাটতির পেছনে সুনির্দিষ্ট কয়েকটি কারণ রয়েছে। যেমন নাব্যতা হ্রাস, বালু উত্তোলন, দূষণ ও মোহনাগুলো অবৈধ জাল দিয়ে ঘিরে রাখা। নদীতে ইলিশের জন্য একটি ভয়ের পরিবেশ তৈরি হয়েছে। ইলিশকে নদীতে ফেরাতে হলে জেলেদের বোঝাতে হবে, মানুষকে সচেতন করতে হবে এবং অনুকূল পরিবেশ তৈরি করতে হবে। এখন কয়েক দিন ইলিশ আসছে, কারণ পূর্ণিমায় নদ-নদীর পানির উচ্চতা বেড়েছে, জালের বিস্তারও কমেছে। তাই অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে।
প্রথম আলো: এবার উজানের দেড় শ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে ভয়াবহ মাত্রার লবণাক্ততা ছড়িয়ে পড়তে দেখা গেল। এর ওপর দূষণ, নাব্যতা-সংকট তো আছেই। এসব রোধে কোনো সুপারিশ আছে?
আনিছুর রহমান: লবণাক্ততার বিষয়টি নিয়ে আমাদের গবেষণা চলছে। এটা শেষ হলে আমরা মতামতসহ সুপারিশ রাখব। তবে নাব্যতা ফিরিয়ে আনা, বালু উত্তোলন ও দূষণ বন্ধে আমরা সব সময়ই বলছি। নিষিদ্ধ জালের ব্যাপারেও একইভাবে আমরা বলছি। অগ্রগতি হচ্ছে। ধরুন, এখন সাড়ে ছয় ইঞ্চির নিচের যেসব ফাঁসের জাল রয়েছে, তা সবই নিষিদ্ধ করা হয়েছে। আগে এটা সাড়ে চার ইঞ্চির নিচে ছিল।
প্রথম আলো: ইলিশ ব্যবস্থাপনায় আধুনিকায়ন হয়েছে, বেড়েছে গবেষণা। এসব কাজ এগিয়ে নিতে কারিগরি কোনো সীমাবদ্ধতা আছে?
আনিছুর রহমান: দেখুন, কোনো সেক্টরের টেকসই উন্নয়নের জন্য প্রথমেই প্রয়োজন দক্ষ জনবল। সেখানে আমাদের ঘাটতি আছে। গবেষণা তো হচ্ছে না দক্ষ জনবলের অভাবে। আবার মৎস্য বিভাগেও জনবলসংকট আছে। গবেষণাগার, ভ্রাম্যমাণ হ্যাচারি, ল্যাব, প্রয়োজনীয় যন্ত্রাংশ, অর্থ—এসবও পুরোমাত্রায় নেই। এটা আমার ৩৩ বছরের গবেষণার অভিজ্ঞতা থেকে বলছি। মৎস্য খাত দেশের অর্থনীতিতে যেভাবে অবদান রাখছে এবং যেভাবে তা দিন দিন বাড়ছে, সে অনুযায়ী এ খাতের উন্নয়ন-প্রত্যাশা আরও বেশি।
প্রথম আলো: আপনাকে আন্তরিক ধন্যবাদ।
আনিছুর রহমান: আপনাকেও ধন্যবাদ।