ঈদের আনন্দ নেই, তবু হাসিমাখা মুখ

বরগুনার সদর উপজেলার মাছখালী গ্রামের জেলে আবদুর রহিমের ছোট্ট ডিঙি। এই ডিঙিতে নদীতে গিয়ে জাল ফেলে মাছ ধরেন তিনি
ছবি: প্রথম আলো

বিষখালী নদীর পাড়ে এলে মায়া লাগে। অনেক প্রশস্ততা নিয়ে বয়ে চলেছে এই নদী। একসময় প্রমত্তা এই নদীর বুকে এখন মানচিত্রের মতো এখানে-ওখানে চর জেগেছে। সাদা বক, হরেক পাখি এসব চরে আটকে পড়া জলজ প্রাণী ছোট মাছ খুঁটে খুঁটে খায়। পাশে সারবাঁধা জেলেদের নৌকা। বরগুনা সদর থেকে প্রায় ৮ কিলোমিটার  পশ্চিমে এই নদীতীরে পাশাপাশি তিনটি জেলে গ্রাম—বরইতলা, লতাকাটা, মাছখালী।

জেলে গ্রামগুলোতে কারও টিন-কাঠের, কারও গোলপাতা, কারও খড়ের জীর্ণশীর্ণ ঘর। এসব গ্রামের প্রায় ৩০০ পরিবার নদীতে মাছ ধরে সংসার চালায়। নদী যেদিন প্রসন্ন হয় সেদিন, তাদের ঘরে খাবার জোটে। যেদিন হয় না, সেদিন ধারদেনায় দুবেলার খাবার তিনবেলায় টেনে নিতে হয়।  

সোমবার দুপুরে অসহ্য গরম আর প্রখর রোদে উঁচু-নিচু, এবড়োখেবড়ো মেঠো পথ পার হয়ে এই গ্রামে পৌঁছে দেখা গেল, ভোগবিলাস নয়, শুধু দুমুঠো খাবারের জন্য কঠোর পরিশ্রমে নিয়োজিত মানুষগুলো কীভাবে রোদ-ঝড়-বৃষ্টি উপেক্ষা করে পরিবারকে আগলে রেখেছে।

নদীর পাশের অন্যের জমিতে এক কক্ষ ও বারান্দাবিশিষ্ট ছোট্ট টিনের দোচালা ঘর আবদুর রহিমের (৫৫)। দুই মেয়ে এক ছেলে। মেয়েদের বিয়ে হয়েছে, ছেলে বিয়ে করে অন্যত্র থাকেন নিজের মতো। একা রহিমকেই পরিবারের জন্য কঠোর সংগ্রাম করতে হয় এই নদীর বুকে। ছোট্ট একটি ডিঙি রহিমের সেই জীবনসংগ্রামের বাহন। সারা রাত বিষখালীর বুকে ভেসে ভেসে বড়শি ফেলে মাছ ধরেন রহিম। কোনো দিন মাছ পান। যেদিন পান, সেদিন খুব ভোরে রাজ্যজয়ের আনন্দ নিয়ে বাড়ি ফেরেন। আবার যেদিন কোনো মাছই পান না, সেদিন রহিমের কাছে ভোর মানে বিষণ্ন এক দিনের শুরু।

সোমবার ভোরটি ছিল রহিমের এমনই। শূন্য হাতে বাড়িফেরা রহিমের সঙ্গে এই মেঠো পথ ধরে মাছখালী যেতে যেতে পথে দেখা। কুশল বিনিময়, কত কথা—তারপর নিয়ে যান ছোট্ট বসতঘরে। ঘরে বসার জন্য কেবল একটি প্লাস্টিকের চেয়ার।

ঈদ কেমন কাটবে, এমন প্রশ্ন তুলতেই অনেকটা অপ্রস্তুত হয়ে যান রহিম। পাশে স্ত্রী পরীভানু।  চুপচাপ হয়ে গেলেন দুজনই। কিছু সময়ের নীরবতা ভেঙে আবদুর রহিম  বললেন, ‘দ্যাহেন, মোগো ঈদ আর অন্যদিন হোমান। সামর্থ্য অইলে কেউর ঘরে একটু নাশতা-ফিন্নি রান্ধন অইবে, অনেকের ঘরেই অইবে না। নতুন কাপড়, ফিন্নি, ভালো খাওন, এই রহম ঈদ করনের ভাগ্য কি আর মোগো আছে।’ আবদুর রহিমের এ নিয়ে কোনো আক্ষেপ আছে, তা চোখে পড়েনি। বরং হাসিখুশি মুখেই তিনি এসব কথা বলে যাচ্ছিলেন।
বললেন, ‘মেয়ের ঘরের দুই নাতিরে ৫০০ টাকা পাঠাইছি নতুন জামাকাপড় কিইন্না দেওনের লইগ্গা। নিজেরা খাই বা না খাই, পরি বা না পরি, জামাইগো ধারে তো আর মাইয়্যারে ছোট্ট অইতে দেওন যায় না।’

রহিমের কথা থামিয়ে পাশে দাঁড়ানো তাঁর স্ত্রী পরীভানু হাসিমুখে বলছিলেন, ‘আইজ রাইতে একটা মাছও বড়িতে (বড়শি) পায় নায়। পাশের এক বাড়িগোনে দুগ্গা চাইল আনছি আর আলুসেদ্ধ করছি। কাইল ঈদ অইবে শুনছি। মোগো দিন তো সবাই সোমান।’

একটু আগে এগিয়েই পথে দেখা গেল, আরেক জেলে কাঁধে জাল নিয়ে নদীর দিকে যাচ্ছেন। ষাটোর্ধ্ব এই জেলের নাম আবদুর রব (৫২)। তিনি বাক্প্রতিবন্ধী। ইশারায় কথা হচ্ছিল। ইশারায় বললেন, ঘরে ছয়জন আছে। হাত ধরে টেনে নিয়ে গেলেন পাশেই ঘরে। ঘরের সামনে দাঁড় করিয়ে একে একে ডেকে আনলেন চার ছেলে-মেয়ে, স্ত্রীকে। একা আয় করে এই সংসার চলে। তিনবেলা দুমুঠো খাবার তুলে দিতেই নিরন্তর সংগ্রাম করতে হচ্ছে রবকে। সেখানে ঈদে নতুন পোশাক, ভালো-মন্দ একবেলা খাবার কীভাবে আসবে, ইশারায় রব এই প্রশ্নই করছিলেন।

মাছখালী গ্রাম পেছনে ফেলে লতাকাটা গ্রামে ঢুকতেই তিন শিশুকে দেখা গেল, বাঁধের ঢালে খেলছে। খালি গায়ে থান কাপড়ের পুরোনো হাফপ্যান্ট পরা এই শিশুরা অপরিচিত লোক দেখে কিছুটা থমকে দাঁড়ায়। কাছে গিয়ে নাম জানতে চাইলে একে একে  বলে, আব্বাস, সফিক, বেল্লাল। ঈদে নতুন জামা কিনেছে কি না, জিজ্ঞেস করতে ফ্যালফ্যাল করে তাকায়। সবাই মাথা নাড়িয়ে না-সূচক জবাব দেয়।