‘ঈদের খুশি ভাসাইয়া নিছে বন্যায়’
‘ঘর নাই। পরের ঘরো থাকি। কামকাজ নাই। কেউ দিলে খাই, না দিলে উপাস থাকি। আমরা বড় কষ্টে আছি। ইবার আমরার ঈদ নাই, ঈদের খুশি বন্যায় ভাসাইয়া নিছে।’
বিধ্বস্ত ঘর দেখিয়ে কথাগুলো বলছিলেন সুনামগঞ্জে বন্যায় ঘর হারানো আলিফ নূর (৪০)। তাঁর বাড়ি জেলার শান্তিগঞ্জ উপজেলার দেখার হাওরপাড়ের মানিকপুর গ্রামে। বন্যায় এই কাঠমিস্ত্রির টিনের চালা ও বেড়ার ঘর ভেসে গেছে। তিন দিকে এখন বেড়া নেই। ঘরের ভেতর নেই কোনো আসবাব। সব বন্যার পানির তোড়ে ভেসে গেছে।
রাত পেরুলেই ঈদুল আজহা। তবে উৎসবের কোনো আমেজ নেই হাওরপাড়ের এসব বন্যার্ত মানুষের জীবনে। বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত ঘরবাড়ি মেরামত ও জীবিকার সংগ্রামে ব্যস্ত তাঁরা। বাধ্য হয়ে গোয়ালের গরু বিক্রি করে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছেন কেউ কেউ। মধ্যবিত্তদের অনেকেই পশু কোরবানি দেওয়ার সামর্থ্য হারিয়েছেন।
গত বছরের তুলনায় এবার সুনামগঞ্জে অন্তত ১০ হাজার পশু কম কোরবানি হবে বলে জানিয়েছে জেলা প্রাণিসম্পদ কার্যালয় সূত্র। গত দুই দিন জেলার কয়েকটি পশুর হাট ঘুরে দেখা গেছে, হাটে অনেক পশু থাকলেও ক্রেতা কম।
শ্রমিক আলিফ নূর বলেন, বন্যার পানি বাড়িঘরে ঢোকার পরপরই স্ত্রী রুপিয়া বেগম ও বৃদ্ধ মা মনতেরা বিবিকে নিয়ে এক কাপড়ে ঘর ছাড়েন। ১০ দিন ছিলেন গ্রামের স্কুলে। পানি নামার পর এসে দেখেন ঘর খালি, সব ভেসে গেছে বন্যায়।
আলিফ বলেন, ‘শুধু আমি না, পুরা গ্রামেই ঈদের কোনো আয়োজন বা আনন্দ নাই। মানুষ চিন্তায় আছে, কিলা (কীভাবে) ঘর বানাইত, কিলা দুইবেলা ভাত খাইয়া বাঁচত।’
গ্রামের বৃদ্ধ আহাদ আলী (৭৮) বন্যায় গৃহহীন হয়েছেন। এখন বাড়ির একপাশে উঁচু জায়গায় খুপরিঘর তুলে বসবাস করছেন। পশু কোরবানি দেওয়ার সামর্থ্য নেই তাঁর। কোরবানির পশুর মাংস খেতে ইচ্ছা করে জানিয়ে আহাদ আলী বলেন, ‘ঘরো সাহায্যের তিন কেজি চাউল আছে। একজন কইছে, কিছু সেমাই আর চিনি দিব। দিলে খাইমু। আর না দিলে ডাইল-ভাতেই ঈদ যাইব।’
পাঁচ ছেলেমেয়ে, স্ত্রী আর বৃদ্ধা মাকে নিয়ে আটজনের সংসার কৃষক রানা মিয়ার (৬০)। বন্যায় ঘর ভেঙেছে। গোলার ধান নষ্ট হয়েছে। পানিতে ভেসে গেছে ঘরের সব জিনিস। বাড়িতে ফিরলেও মেঝেতে মাটি এবড়োথেবড়ো হয়ে থাকায় ঘুমাতে কষ্ট হয়। ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের কারও গায়ে কাপড় আছে, আবার কারও নেই। পায়ে নেই স্যান্ডেলও।
এ অবস্থায় ঈদ নিয়ে বাড়তি কোনো চিন্তা নেই জানিয়ে রানা মিয়া বলেন, ‘পারলে কিছু চাউল-ডাইল দেইন যে। ঈদের দিন বাইচ্চাইন তেরে উপাস রাখলে কষ্ট লাগব।’
সুনামগঞ্জের এবারের ভয়াবহ বন্যা লাখো মানুষকে নিঃস্ব করে দিয়েছে। বন্যায় সবকিছু হারিয়ে অনেকেই পশু কোরবানি দেওয়ার সামর্থ্য হারিয়েছেন। আবার আগে এক গরু দিয়ে কোরবানি দিতেন, এমন অনেকে এবার ভাগে পশু কোরবানি দিচ্ছেন।
ঈদের বাজারেও পড়েছে বন্যার প্রভাব। বেচাকেনা কম। মানুষও কম। সুনামগঞ্জ শহরের দোজা শপিং সেন্টারের ব্যবসায়ী সোহেল আহমদ জানান, এমনিতেই মানুষ এই ঈদে নতুন কাপড়চোপড় কেনেন কম। এর ওপর এবার বন্যায় মানুষজন আরও বিপাকে পড়েছেন। হাতে টাকাপয়সা নেই। তাই একেবারেই বেচাকেনা নেই।
জানতে চাইলে সুনামগঞ্জ সচেতন নাগরিক কমিটির (সনাক) সভাপতি আইনুল ইসলাম বলেন, ‘সুনামগঞ্জের মানুষ এর আগে কখনো এমন অসহায় পরিস্থিতিতে পড়েনি। বন্যায় সবাই কমবেশি ক্ষতিগ্রস্ত। মানুষ ঘুরে দাঁড়াতে পারছে না। এ অবস্থায় ঈদ এলেও সুনামগঞ্জে ঈদের তেমন আমেজ নেই। যেদিকে তাকাবেন, শুধু মানুষের কষ্ট আর হাহাকার চোখে পড়বে।’
সুনামগঞ্জে গত ১৬ জুন থেকে ভয়াবহ বন্যা দেখা দেয়। অসংখ্য বাড়িঘর, সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, রাস্তাঘাট বন্যার পানিতে তলিয়ে যায়। সুনামগঞ্জ টানা চার দিন সারাদেশ থেকে বিচ্ছিন্ন ছিল। হাজার হাজার মানুষ আশ্রয় নেয় বিভিন্ন শিক্ষপ্রতিষ্ঠান, উঁচু সড়ক ও আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে। সরকারি হিসাবে বন্যায় জেলার ৩০ লাখ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। পরিস্থিতির উন্নতি হওয়ায় অনেকেই বাড়িতে ফিরেছেন। তবে যাঁদের বাড়িঘরের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে, তাঁরা এখনো ফিরতে পারছেন না।